কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৃষ্টিতে তিন চ্যালেঞ্জ সবার আগে দরকার স্বচ্ছতা

বাংলাদেশ ব্যাংক (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) ২০০৯ সালের মূল্যায়নের ভিত্তিতে ২০১০ সালে জাতীয় অর্থনীতিকে তিনটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বলে যে বক্তব্য দিয়েছে, তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণের সুযোগ নেই। চ্যালেঞ্জ তিনটি হচ্ছে—অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচন।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রথম চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবিলা করা গেলে দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রশস্ত ক্ষেত্র তৈরি হবে এবং দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাফল্য অর্জিত হলে তৃতীয় চ্যালেঞ্জ আর আগের মতো কঠিন থাকবে না। ২০০৯ সালের অর্থনীতির মূল্যায়ন ও পরবর্তী অর্থবছরের সম্ভাব্য চিত্র তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও চলতি অর্থবছরে জিডিপির ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে এবং মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা যাবে। বিশ্বমন্দার কারণে নানা উত্কণ্ঠার মধ্য দিয়ে ২০০৯ সালের যাত্রা শুরু হলেও সরকারের গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রয়োজনীয় সহায়তা ও সমর্থনমুখী মুদ্রানীতি প্রণয়নের ফলে বাংলাদেশ বৈশ্বিক মন্দায় কম ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বলে তিনি দাবি করেছেন।
২০০৯ সাল বিশ্বজনীন অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যতটা ভয়ঙ্কর হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল, তেমনটি হয়নি—এটা সত্যি কথা। কিছু ব্যতিক্রম বাদে এ লক্ষণ বিশ্বজুড়ে দেখা যাচ্ছে। আমাদের দুই বড় প্রতিবেশী দেশ চীন এবং ভারতের অর্থনীতি তো ঘুরে দাঁড়িয়ে এর মধ্যে রীতিমত চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। আসলে বিভিন্ন দেশের সরকার বিপুল তহবিল নিয়ে মন্দা মোকাবিলায় দ্রুত হস্তক্ষেপ করায় বিশ্বমন্দার স্থায়িত্ব হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে। তুলনামূলকভাবে আমাদের দেশে বরং মন্দা প্রতিরোধে সরকারের সক্রিয়তা কম ছিল। তারপরও মন্দার দাপট কম অনুভূত হওয়ার দুটি বড় কারণ হচ্ছে কৃষিতে ভালো ফলন এবং প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো বিপুল অঙ্কের রেমিট্যান্স। আমন ফলন মার না খেলেও আশানুরূপ হয়নি, এ বাস্তবতাকে সঙ্গী করে আমরা ২০১০ সালে পা রেখেছি। আসন্ন বোরো মৌসুমের ভালো-মন্দের ওপর এবছর জাতীয় অর্থনীতির চেহারা অনেকখানি নির্ভর করছে। কারণ কৃষিখাত বাদে দেশের অর্থনৈতিক স্থবিরতা এখনও অনেকটা জরুরি তত্ত্বাবধায়কীয় আমলের মতোই রয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর যে বলেছেন দেশি উদ্যোক্তারা এখন আবার নতুন বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসছেন, কথাটা আংশিক সত্য। আসলে বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসতে চাইছেন। কিন্তু এগুতে পারছেন কই। সরকারদলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকদের লাগামহীন দাপাদাপি এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাজুক দশা ছাড়াও বিদ্যুত্ ও জ্বালানি সঙ্কট নতুন মিল-ফ্যাক্টরি স্থাপনের পথে হিমালয়সম বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিদ্যুত্ ও গ্যাস সঙ্কটের জন্য চালু মিল-কারখানাগুলোই ঠিকমত চলছে না। চালু গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে নতুন গ্যাসকূপ খনন করে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ একবছরেও দৃশ্যমান নয়। বিদ্যুত্ সরবরাহ বাড়ানোর তত্পরতা বক্তৃতায়ই সীমাবদ্ধ। গ্যাস ও বিদ্যুত্ সংযোগের জন্য অপেক্ষায় থাকতে থাকতে অনেক উদ্যোক্তার বসানো যন্ত্রপাতিতে জং ধরে গেছে। তারা কী করবেন বুঝে উঠতে না পেরে দিশেহারা। এ অবস্থায় আরও নতুন উদ্যোক্তা বিনিয়োগে কেন ‘আগ্রহী’ হয়ে উঠেছেন, তার হেতু ব্যাখ্যা করেননি ড. আতিউর রহমান।
এছাড়া জটিলতা আরও আছে। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বর্তমান সরকার ‘আমরা’ এবং ‘তোমরা’র ভেদরেখা সৃষ্টি করে ফেলেছে বলে গুঞ্জন দিন দিন তীব্রতা পাচ্ছে। সেক্ষেত্রে এটা অবধারিত যে, নতুন কোনো উদ্যোক্তা বিনিয়োগে এগিয়ে এলেও তিনি যদি ‘তোমরা’ পঙিক্তভুক্ত হন, তবে পদে পদে বাধাগ্রস্ত এবং শেষ
পর্যন্ত বিপন্ন হবেন। তাই, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য আন্তরিক আগ্রহ থাকলে সরকারকে সবার আগে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। জরুরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যে আস্থার সঙ্কট জন্ম নিয়েছে, তা দূর করা না
গেলে পরিবেশ কিছুতেই বিনিয়োগের অনুকূল হবে না। আর তা করার জন্য সবার আগে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ফিরিয়ে আনতে হবে স্বচ্ছতা। পাইয়ে দেয়ার সংস্কৃতিকে ধারণ করে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি ও সুষম উন্নয়নের আশা না করাই ভালো। সুতরাং স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনাই ২০১০ সালে অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ, একথা বললে সব কথাই বলা হয়ে যায়।

No comments

Powered by Blogger.