'দোয়েল' ল্যাপটপ ও একটি অনুরোধ-তথ্যপ্রযুক্তি by জাকারিয়া স্বপন

নিজের একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। ছোটবেলায় আমাদের স্কুলে ইউনিসেফের খাতা দেওয়া হতো। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের নিতান্তই মফস্বলের, এমনকি গ্রামের স্কুলে পড়ার সুযোগও হয়েছে। এই বয়সেও পরিষ্কার মনে আছে, 'ভেদরগঞ্জের' যেই স্কুলটিতে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়তাম, সেটি ছিল টিনের, মাটির মেঝে, জানালা খোলা।
মাটির মেঝেটি থেকে চারদিকের মাটি সরে গেছে। আমরা টিনের বেড়ার নিচ দিয়েও ক্লাসে আসা-যাওয়া করতে পারতাম (টিকা দেওয়ার দিন এটি বেশ কাজে দিত)। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক খালি পায়ে স্কুলে আসতেন। তার পা ছিল ফাটা। কখনও সেই পায়ে জুতার ছোঁয়া লেগেছে কি-না জানা হয়নি। সেই ভাঙা স্কুল দিয়েই বাংলাদেশ নামের দেশটার যাত্রা শুরু। আমাকে যদি সেই ফ্রি বই-খাতা দেওয়া না হতো, যদি ফ্রি প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ দেওয়া না হতো, আমার বাবার ক্ষমতা ছিল না, আমাদেরকে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর। আমি নিজের টাকায় শুধু আমেরিকাতে লেখাপড়া করেছি। বাকি সব পড়াশোনা বাংলাদেশে, ফ্রি।
আমি জানি, এই গল্প বাংলাদেশের সব মানুষের, যারা দেশ পরিচালনা করছেন, কিংবা করছেন না।
২. এই সরকার প্রচণ্ড রকমের ভালো একটি কাজে হাত দিয়েছে। বাংলাদেশে ল্যাপটপ বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ল্যাপটপটির ব্র্যান্ড নাম জাতীয় পাখি 'দোয়েল'-এর নামে। ল্যাপটপটির লোগো যদিও আমার পছন্দ হয়নি (ওটা বিখ্যাত ডেল কম্পিউটারের লোগো থেকে নেওয়া হয়েছে। আমাদের শিল্পীরা আরও অনেক সুন্দর এবং স্বকীয় লোগো বানাতে জানেন।) কিন্তু উদ্যোগটি অসাধারণ। ল্যাপটপ জোড়া দেওয়া হলো খুবই সাদামাটা ধরনের একটি কাজ। কিন্তু এই সহজ কাজটিই আমরা অনেক সময় করতে পারি না কিংবা করতে চাই না। পুরো পৃথিবীতে কম্পিউটার যন্ত্রাংশের মূল্য বর্তমানে এমন সস্তা হয়ে গেছে যে, সেগুলো এনে জোড়া দিয়ে বাজারজাত করাটা জটিল কিছু নয়। যারা এই প্রকল্পটির সঙ্গে যুক্ত তাদের জন্য প্রাণঢালা ভালোবাসা।
ল্যাপটপ তৈরির কাজ প্রায় শেষ। যতদূর জেনেছি, দোয়েল বাজারে আসার জন্য প্রস্তুত। আগামী মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেটা উদ্বোধন করবেন।
এ ক্ষেত্রে একটি কথা না বললেই নয়। পণ্যটি বাজারে ছাড়ার সময় যেন তাড়াহুড়া করা না হয়। দশ বছরের বেশি সময় সিলিকন ভ্যালিতে কাজ করার সুবাদে দেখেছি, প্রাথমিক রিলিজগুলোতে অনেক সমস্যা থাকে। তাই, এগুলোর আলফা, বেটা টেস্ট না করে পুরোপুরি বাজারে ছাড়াটা ঠিক হবে না। আমি এখনও শুনিনি, কেউ দোয়েলের বেটা টেস্টিং করছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে স্যাম্পল পাঠিয়ে বেটা টেস্টিং খুব সহজেই করানো যেতে পারে। তারপর সেগুলোতে যে সমস্যা পাওয়া যাবে, সেগুলো ঠিক করে তারপর বাজারজাত করা ঠিক হবে। নইলে বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে।
৩. বর্তমানের আধুনিক প্রযুক্তি ল্যাপটপ/ট্যাবলেট_ এগুলো হলো শিক্ষা উপকরণ। এগুলোর সঙ্গে যখন ইন্টারনেট যুক্ত হয়, তখন ওই যন্ত্রগুলো শুধু যন্ত্র থাকে না, হয়ে ওঠে বিশাল এক লাইব্রেরি। পুরো বিশ্বের জ্ঞানের ভাণ্ডার চলে আসে তার হাতের মুঠোয়। চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, নাকি চাঁদের চারদিকে পৃথিবী ঘোরে_ এটা জানার জন্য কত মানুষকে যে জিজ্ঞেস করেছি ছোটবেলায়। দুটি মতবাদই ছিল। কিন্তু এখনকার বাচ্চারা মুহূর্তেই ইন্টারনেটে একটি এনিমেশন দেখেই বুঝে ফেলতে পারে, সৌরজগৎ কীভাবে চলে। এবং এটা কেবল বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরাই পারছে তা নয়; পুরো গ্রহের শিক্ষার্থীরাই এ সুযোগ পাচ্ছে। এর ফলে আমাদের মতো উঠতি দেশগুলোর জন্য বিপদ আরও বেড়েছে। পৃথিবীব্যাপী শিক্ষার একটি অসম প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। আমাদের সময় যখন এসব ছিল না, তখন বাংলাদেশের একটি ছাত্র ক্লাস টেনে যা জানত, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ছাত্ররা হয়তো তার কাছাকাছিই জানত। কিন্তু এখন ফারাক অনেক বেশি। আজ যে ছাত্রটির কাছে আধুনিক শিক্ষা উপকরণ রয়েছে, সে অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি জানছে। ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক অনেক পিছিয়ে পড়বে। আমরা অনেক চেষ্টা করে হয়তো চার পা এগিয়েছি, কিন্তু ততক্ষণে তাইওয়ান বা সিঙ্গাপুরের একটি ছাত্র হয়তো দশ পা এগিয়ে গেছে। কিন্তু এই ল্যাপটপগুলো সেই শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের দেশকে সত্যি সত্যি একটি ধাক্কা দিতে পারে।
এ সরকারের আমলেই প্রতিটি উপজেলায় ফাইবার অপটিক যাচ্ছে, যার মাধ্যমে ইন্টারনেট সহজলভ্য হয়ে উঠবে। তারপর এসেছে ওয়াইম্যাক্স। কিছুদিন পর আসবে থ্রি-জি। যখন এত কর্মযজ্ঞ একসঙ্গে হচ্ছে, তখন এই ল্যাপটপ কর্মসূচি খুবই সময়োপযোগী।
এই ইনফ্রাস্ট্র্রাকচারটি সঠিকভাবে তৈরি হলে বিভিন্ন ধরনের এন্টারপ্রেনার এগিয়ে আসবেন এটাকে ব্যবহার করে নতুন নতুন জিনিস তৈরি করতে। দেশ এটার সুবিধা পাবে_ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
৪. ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১। ভারতের তামিলনাড়ূ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জে. জয়ললিতা বিনামূল্যে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ল্যাপটপ বিতরণের কাজ শুরু করেছেন। তিনি নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বিজয়ী হলে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে ল্যাপটপ দেবেন। সেই নির্বাচনী ওয়াদা রাখতে গিয়ে তিনি ৭০ লাখ ছাত্রছাত্রীকে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ল্যাপটপ দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছেন। এতে তার খরচ হবে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তামিলনাড়ূ হলো তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষায় অনেক অগ্রসর একটি রাজ্য। ওখানকার অজ-পাড়াগাঁয়ের কলেজের ছেলেমেয়েরা সরাসরি আমেরিকাতে হাইটেক কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে কাজ করতে যায়, যেখানে আমাদের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের কপালে সেটা জোটে না।
ভারতের একদিকে মানুষ ক্ষুধার্ত, আরেকদিকে পুরো বিশ্বকে জয় করতে যাচ্ছে এবং সবাই জানে, সেই ক্ষুধাও তারা একদিন জয় করবে। তার একমাত্র মূলমন্ত্র হলো শিক্ষা। ভারত যে আইআইটি দিয়ে শুরু করেছিল, তারপর তারা শিক্ষা খাতে ব্যয় আর কমায়নি। তার ফল তারা পেতে শুরু করেছে এবং ভবিষ্যতেও পাবে।
বর্তমানে শিক্ষার পদ্ধতিতে যে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে, আমরা যদি এখনই সেটার সঙ্গে নিজেকে অ্যালাইন না করি, তাহলে আজ থেকে দশ বছর পর হা-পিত্যেশ করতে থাকব। সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং সেটাকে কাজে লাগানোর এখনই সময়।
৫. মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, বাংলাদেশের তৈরি দোয়েল ল্যাপটপ আমাদের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে দেওয়া হোক। তার কিছু কারণ ও প্রণালীর কিছুটা আউটলাইন এখানে লিখে দিচ্ছি।
ক) বাংলাদেশ একটি উঠতি দেশ। এখানে আমরা সবাইকে বিনামূল্যে একটি ল্যাপটপ দেওয়ার কথা বলছি না। ল্যাপটপ দেওয়া হবে, প্রতি পাঁচ জনে একটি। এবং প্রথম পর্যায়ে দুই লাখ ল্যাপটপ দেওয়া যেতে পারে; তাতে দশ লাখ ছাত্রছাত্রী এর আওতায় আসবে। প্রাথমিকভাবে এর ফলাফল দেখে নিয়ে পরবর্তী বছরগুলোতে এ প্রোগ্রামটিকে আরও গুছিয়ে ফেলা যাবে।
খ) আমাদেরকে রিসোর্স শেয়ার করতে শিখতে হবে। গ্রুপে কীভাবে কাজ করতে হয়, সেটা শিখতে হবে। যদি একটি ল্যাপটপ পাঁচ জন ছাত্রছাত্রীকে দেওয়া হয়, তখন তারা সবাই মিলে ওটার মালিক হবে। কেউ চাইলেই সেটা বিক্রি করে দিতে পারবে না। রিসোর্স কম থাকলে এভাবেই চলতে হবে। কিন্তু কিছু রিসোর্স আমাদেরকে দিতেই হবে।
গ) দোয়েল ল্যাপটপের বাজারমূল্য রাখা হয়েছে সর্বনিম্ন কনফিগারেশন দিয়ে দশ হাজার টাকা। তাহলে তার তৈরির খরচ হওয়ার কথা পাঁচ হাজার টাকার কাছাকাছি। এই দুই লাখ ল্যাপটপ দিতে সরকারের খরচ হবে ১০০ কোটি টাকা (২,০০,০০০ু৫,০০০ টাকা = ১০০,০০,০০,০০০ টাকা)। বাংলাদেশ সরকার নিশ্চয়ই এটি প্রতি বছর এফোর্ড করতে পারে।
ঘ) পৃথিবী যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে প্রতিনিয়ত কাগজের মূল্য আরও বাড়তেই থাকবে। আর এক দশক পরেই কাগজের বই পড়া হবে বিলাসিতা। উন্নত বিশ্ব কাগজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ইলেক্ট্রনিক্সই হবে অদূর ভবিষ্যতের মূল চালিকাশক্তি। সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হবে বিকল্প শক্তি_ কীভাবে সূর্যকে ব্যবহার করে চালানো যায় এই বিশাল ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যগুলো। আর দিন দিন নতুন ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যগুলো বিদ্যুৎও টানছে কম। এটাই পৃথিবীর রোডম্যাপ। এর সঙ্গে যোগ হবে ই-বুক, ভিডিও আর টিউটোরিয়াল।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার সরকার 'ডিজিটাল বাংলাদেশ'-এর স্লোগান নিয়ে এবং নির্বাচনী ওয়াদা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে এবং সেই লক্ষ্যে আপনার সরকার কাজও করে যাচ্ছে। প্রতি বছর এত সহজেই দশ লাখ ছাত্রছাত্রীকে এমন সুন্দর একটি শিক্ষা ব্যবস্থার আওতায় আনা যায়, যা বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে দিতে পারে। এত অল্প বিনিয়োগে এত বিশাল ফল আর কোথাও পাওয়া যাবে না। বিষয়টি আপনার সুনজরে আসবে আশা করি।
৬. এবারে আরেকটি গল্প। ১৯৯৮ সাল। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, অধ্যাপক মুহম্মদ কায়কোবাদ এবং অধ্যাপক জাফর ইকবালকে নিয়ে আমরা প্রথম আয়োজন করলাম 'জাতীয় কম্পিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা' (সংক্ষেপে এনসিপিসি)। আমেরিকা থেকে দেখে গিয়ে সেটার আদলে তরুণ প্রোগ্রামারদের উৎসাহিত করার জন্য দেশে আমরা এ উদ্যোগটি নিয়েছিলাম।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন প্রথম টার্মে ক্ষমতায় এসেছেন। তিনি এই অনুষ্ঠানের পুরস্কার বিতরণীর প্রধান অতিথি হতে সম্মতি দিলেন। সেই স্টেজে জামিল স্যার আমাকে কানে কানে বললেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে কিছু একটা চাইতে।
আমার বক্তৃতার সময় বললাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি পায়ে বিনিয়োগ না করে, মাথায় বিনিয়োগ করুন।
যদিও সেদিন ফুটবলপ্রেমীরা একটু ক্ষেপে গিয়েছিলেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজের বক্তৃতার সময় ঠিকই প্রতিটি গ্রুপের বিজয়ীদের এক লাখ টাকার বাড়তি পুরস্কার ঘোষণা করেন। এবং বিজয়ীরা যথাসময়ে সেই টাকা পেয়েও যান।
আজ এক যুগ পেরিয়ে গিয়েছে। এখন প্রধানমন্ত্রী নিজেই ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলেন। অনেক পরিবর্তন হয়েছে দেশের। সেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে মাত্র দুই লাখ দেশি ল্যাপটপ 'দোয়েল' চাইছি। মন বলছে, তিনি এটা দেবেন।

জাকারিয়া স্বপন : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ
zs@priyo.com

No comments

Powered by Blogger.