সময়ের কথা-৭০০ কোটিতে বাংলাদেশের হিস্যা নিয়ে দুর্ভাবনা by অজয় দাশগুপ্ত

মরা যা করতে পারি তা হচ্ছে, মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হার যতটা সম্ভব কম রাখা যায়। এজন্য ব্যাপক প্রচার দরকার। স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে বিষয়টি থাকতে হবে। স্বাস্থ্যসেবার আয়োজন বাড়াতে হবে। পরিবারের আকার সীমিত রাখার জন্য যত ধরনের উপকরণ দরকার সব জোগাতে হবে সময়মতো।


এ জন্য সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। এ কাজে বছরে যদি তিন-চার হাজার কোটি টাকাও ব্যয় হয় সেটা জোগাতে কার্পণ্য করা চলবে না। কারণ অনাকাঙ্ক্ষিত নতুন মুখের সংখ্যা বেড়ে গেলে তাদের জন্য ব্যয় করতে হবে আরও বেশি অর্থ


অক্টোবর, ২০১১ সালে বাংলাদেশের কয়েকজন চিকিৎসক ও নার্স গিয়েছিলেন সোমালিয়া এবং কেনিয়ায়। তাদের পাঠিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আফ্রিকার সোমালিয়ায় যে অরাজক অবস্থা চলছে, সেটা তারা জানেন। সোমালিয়ার জলদস্যুরা ভারত মহাসাগরে জাহাজ আটকে রেখে যাত্রীদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করে এবং আরও ভয়ঙ্কর নানা অপরাধ সংঘটিত করে। বাংলাদেশের একদল নাবিকও তাদের কবলে পড়েছিল। সোমালিয়ায় কলেরা-ডায়রিয়া রোগ প্রতিরোধের কাজে সহায়তার জন্য গেলে বেঘোরে প্রাণ হারানোর ভয় আছে, সেটা জেনেও যেতে হয়েছে চাকরি রক্ষার তাগিদে। সে দেশের রাজধানী মোগাদিসুতে যে কয়েক দিন তারা ছিলেন, হোটেল আর হাসপাতাল_ এর বাইরে কোথাও যাওয়ার প্রশ্ন ছিল না। শপিং করার কথা কেউ ভাবেননি। চারদিক থেকে দিন-রাত প্রায় সব সময় শোনা যেত গুলির শব্দ। বাংলাদেশের বয়স্ক নারী-পুরুষদের ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার নয় মাস স্মরণে আছে। সোমালিয়ার অবস্থা এখন অনেকটা সে ধরনের। কে কাকে গুলি করে মারছে, কেন মারছে_ কেউ জানে না। বন্দুকধারী পাহারাদার নিয়ে চলতেন তারা, যাদের ওপর নির্দেশ ছিল কাউকে সন্দেহ হলেই গুলি করে দেবে এবং এ জন্য কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। সোমালিয়ায় অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ঢাকায় ফিরে চিকিৎসক ও নার্স দলের একজন এক আড্ডায় স্বগতোক্তি করেন : 'হাসিনা-খালেদা জিন্দাবাদ'। কেন তার এমন উক্তি সেটা জানতে চাইলে বলেন : 'বাংলাদেশে অনেক ভালো আছি।'
এ মত নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ হলে, দুর্নীতি কমাতে পারলে এবং গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহতভাবে অনুসরণ করা হলে মানুষ আরও ভালো থাকতে পারে বলেই জোরালো মত রয়েছে। আমাদের জন্য এমন কিছু ইস্যু রয়েছে যেখানে প্রয়োজন শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে ঐকমত্য ও সমঝোতা। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এমনই একটি ইস্যু। সোমালিয়ায় কয়েক দিন থেকে বাংলাদেশকে যার মনে হয়েছে 'স্বর্গরাজ্য', তার জন্য একটি শঙ্কাজনক ভবিষ্যৎ তুলে ধরা যায় : যদি ছোট্ট এ ভূখণ্ডে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা না যায়, তাহলে বাংলাদেশেও কিন্তু সীমিত সম্পদ নিয়ে মানুষে মানুষে কাড়াকাড়ি পড়ে যেতে পারে এবং তার পরিণতিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে ব্যাপক সহিংসতা।
এই অক্টোবরেই বিশ্বের লোকসংখ্যা দাঁড়াবে ৭০০ কোটিতে। ২০৭ বছর আগে ১৮০৪ সালে বিশ্বের লোকসংখ্যা ১০০ কোটিতে পেঁৗছায়। ১০০ থেকে ২০০ কোটিতে পেঁৗছাতে সময় লাগে ১২৩ বছর। মাত্র ৫১ বছর আগে ১৯৬০ সালে বিশ্বের লোকসংখ্যা ছিল ৩০০ কোটি। এখন কাউন্টডাউন চলছে ৭০০ কোটির জন্য! ১৯৯৮ সালে এ লোকসংখ্যা ৬০০ কোটিতে পেঁৗছায়। তারপর মাত্র ১৩ বছর যেতে না যেতেই বেড়েছে ১০০ কোটি। পরিবার ছোট রাখার জন্য বিশ্বের নানা দেশে ব্যাপক প্রচারণা চলছে। সেই ১৯৬০ সালের দিকেই পূর্ব পাকিস্তানে স্লোগান ছিল, 'দুইটি সন্তানই যথেষ্ট, তিনের বেশি আর নয়।' গত পঞ্চাশ বছরে বেড়েছে চিকিৎসা সুবিধা, পরিবার ছোট রাখায় আগ্রহী অনেকেরই তা আওতাধীন। পরিবার ছোট রাখলে অনেক দেশে সরকারি সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে। তবে সব দেশের চিত্র কিন্তু এক নয়। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল অনেক দেশ জনসংখ্যা না বাড়ায় দারুণ উদ্বিগ্ন। আমেরিকা যে ডিভি লটারি করে গরিব দেশ থেকে লোক নেয়, তার কারণ কিন্তু শ্বেতাঙ্গরা পরিবার বড় করতে চায় না। তাদের দেশে বয়স্ক মানুষ বেশি, যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনের সব কাজ করতে পারে না। তাদের সেনাবাহিনীর সদস্য করা যায় না, ট্রাফিক পুলিশ করা যায় না। কঠোর শ্রমের কাজ চলে না বুড়োদের দিয়ে। অন্যদিকে অনেক গরিব দেশে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং নানাভাবে চেষ্টা করেও লোকসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। বাংলাদেশ রয়েছে শেষের দলেই। চলি্লশ বছরে এ দেশের লোকসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। জনসংখ্যা সীমিত রাখার জন্য চেষ্টা যে একেবারে চলছে না, সেটা বলা যাবে না। কিন্তু যা করা উচিত, সরকার সেটা করছে না। রাজনৈতিক দলগুলোর এজেন্ডায় এটা গুরুত্ব পায় না। এমনকি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, বিশেষভাবে বিশেষজ্ঞ মহলের কাছেও এটা 'এ আর এমনকি সমস্যার' চেয়ে বেশি কিছু নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক একেএম নূর-উন-নবী একটি হিসাব দিয়েছেন এভাবে : ১৭০০ সালে এ ভূখণ্ডের লোকসংখ্যা ছিল ১ কোটি ৭০ লাখ। ২৩০ বছরে তা দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু এরপর দ্বিগুণ হতে সময় লেগেছে মাত্র ৪৩ বছর। আর ১৯৭৪ সালে যা ছিল, দ্বিগুণ হতে সময় লেগেছে ৩০ বছর। প্রতি বছর লোকসংখ্যা বাড়ছে ১.৮ থেকে ২ শতাংশ হারে।
আমাদের দেশে এখনও তরুণ বয়সী নারী-পুরুষ বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, ২০০৫ সালে আমাদের লোকসংখ্যার প্রায় ৫৬ শতাংশের বয়স ছিল ১৫ থেকে ৫৯ বছর। ষাটোর্ধ্ব নারী-পুরুষ মাত্র ৬ শতাংশের কিছু বেশি। আর ৩৮ শতাংশের মতো রয়েছে ১৪ বছরের কম বয়সী। বাংলাদেশের এখন একটি গুরুতর সমস্যা হচ্ছে মেয়েদের ১৮ বছরেরও অনেক কম বয়সে বিয়ে হওয়া। ২০০৭ সালের হিসাবে দেখা যায়, মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স ছিল ১৫ বছর তিন মাস। ১০ বছর আগে ১৯৯৭ সালে ছিল ১৪ বছর ২ মাস। এই সময়ে শিক্ষার হার বেড়েছে। জনসংখ্যা নিয়ে মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রচার বেড়েছে। শিশুমৃত্যু ও সন্তান প্রসবের সময় মায়ের মৃত্যুর হার কমেছে। নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। ৩০ লাখ নারী তৈরি পোশাক শিল্পে কাজ করে। নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলায় সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নারী জনপ্রতিনিধির সংখ্যা ২০-২৫ হাজার হবে। জাতীয় সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন রয়েছে ৫০টি। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা দুই দশক ধরে নারী। কিন্তু মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স তেমন বাড়ানো সম্ভব হয়নি। অথচ এটা করা সম্ভব হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে লাগাম টানা সহজ হয়। অনেক নারী পরিবারে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অনেক পরিবারে বধূ নির্যাতন প্রতিদিনের ঘটনা। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ইতিমধ্যেই আমাদের ভূখণ্ডের আয়তন এবং সম্পদের সম্ভাবনার বিচারে অনেক বেশি হয়ে গেছে। স্বাধীনতার চার দশকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন যথেষ্ট ঘটেছে। গ্রামে থেকেও এখন যথেষ্ট আয় করা সম্ভব। গ্রাম ও ছোট ছোট শহর থেকে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন লোক আসছে। অনেকে আসছে কাজের আশায় এবং কোনো না কোনোভাবে মিলছেও তা। কিন্তু তারা থাকতে বাধ্য হচ্ছে বস্তি এলাকায় কিংবা ফুটপাত দখল করে। রাজধানীতে ৩০ লাখের বেশি বস্তিবাসী রয়েছে বলে একাধিক সমীক্ষায় প্রকাশ। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার পানির ব্যবস্থা করা যায় না। স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট সুবিধা অভাবনীয়। এর জন্য স্থান দরকার। বস্তিতে তা মিলবে কোথায়? এ পরিবেশে থেকে ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে ঠিকভাবে পড়াশোনা করতে পারে না।
বাংলাদেশের সম্পদ বাড়ছে। চার দশকে অর্থনীতিতে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা। এক সময়ে ধানমণ্ডি ছিল অভিজাত লোকদের বসতি এলাকা। এখন গুলশান-বনানী-বারিধারা-উত্তরাসহ এ রকম কয়েকটি এলাকা কেবল রাজধানীতেই। দামি গাড়ির সংখ্যা অনেক। প্রাইভেটকারের চাপে রাস্তায় বাস চলাচল করতে পারে না। শপিং মল গড়ে উঠছে মূল শহর থেকে অনেক দূরের এলাকায়। বছরে এক লাখ টাকা বা তার বেশি অর্থ ব্যয় করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী। তারপরও বলা যায়, যত লোক এবং যেভাবে সংখ্যা বাড়ছে, তাদের বেশিরভাগের ভালো থাকার জন্য যথেষ্ট সম্পদ নেই। এ সম্পদ বাড়াতেই হবে। অন্যথায় সোমালিয়ায় যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশেও তা হতে পারে।
আমাদের তরুণ প্রজন্ম অনেক স্বপ্ন দেখে। তারা একাত্তরে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। তাদের পরের প্রজন্ম একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ যারা করেছে তাদের বিচারের দাবিতে দৃঢ়সংকল্প হয়েছে। কিন্তু তা অর্থনীতিতে এগিয়ে চলার নিশ্চয়তা দেয় না। কৃষি-শিল্পে আমাদের সমৃদ্ধ হতেই হবে। তবে এর পাশাপাশি লোকসংখ্যা সীমিত রাখার জন্যও চেষ্টা করতে হবে। এখন আমরা হতাশা ব্যক্ত করে বলতেই পারি যে, ২০১১ সালে যদি বাংলাদেশের লোকসংখ্যা ১১ কোটিতে সীমিত রাখা যেত! ১০ কোটিতে সীমিত থাকলে তো সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আমরা থাকতে পারতাম। কিন্তু লোকসংখ্যা তো ১৫ বা ১৬ কোটিতে পেঁৗছে গেছে। কেউ জোর করে তা কমাতে পারবে না। এমন কোনো জাদুমন্ত্রও কারও জানা নেই যে বলবে_ 'থেমে থাকো, যেখানে আছো।' আমরা যা করতে পারি তা হচ্ছে, মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হার যতটা সম্ভব কম রাখা যায়। এ জন্য ব্যাপক প্রচার দরকার। স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে বিষয়টি থাকতে হবে। স্বাস্থ্যসেবার আয়োজন বাড়াতে হবে। পরিবারের আকার সীমিত রাখার জন্য যত ধরনের উপকরণ দরকার সব জোগাতে হবে সময়মতো। এ জন্য সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। এ কাজে বছরে যদি তিন-চার হাজার কোটি টাকাও ব্যয় হয় সেটা জোগাতে কার্পণ্য করা চলবে না। কারণ অনাকাঙ্ক্ষিত নতুন মুখের সংখ্যা বেড়ে গেলে তাদের জন্য ব্যয় করতে হবে আরও বেশি অর্থ। এ ধরনের কাজের তদারকি দরকার নিয়মিত। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার বৈঠক করেন প্রতি সপ্তাহে। জনসংখ্যা কমিয়ে রাখার দায়িত্ব যাদের রয়েছে তাদেরও প্রতি সপ্তাহে বসা দরকার। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বেই এ ধরনের বৈঠক নিয়মিত করা দরকার। এখানে যেসব সিদ্ধান্ত হবে, তার বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কি-না সেজন্য এর প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশ সোমালিয়া হয়ে যায়নি বলে স্বস্তিবোধ করা হচ্ছে। কিন্তু লোকসংখ্যা সীমিত করতে না পারলে আমাদের এখানেও কিন্তু এ ধরনের দুঃস্বপ্নের পরিণতি নেমে আসতে পারে!

অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.