'কঠোর শাস্তিযোগ্য'

রু পাচারকারী সন্দেহে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) জওয়ানরা এক বাংলাদেশি যুবকের ওপর যে অত্যাচার চালাইয়াছে, তাহা পাশবিক নয়। কেননা কোনো পশু কখনও সমজাতীয় কিংবা বিজাতীয় কোনো প্রাণীর প্রতিও এমন নিষ্ঠুর আচরণ করে না। এই আচরণকে কেবল বর্বরোচিতই বলা যায়।


কারণ মানবেতিহাস বারংবার এমন বর্বর নিষ্ঠুরতায় কলঙ্কিত হইয়াছে। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর বর্তমান বর্বরতা হুন দলপতি অ্যাটিলার নৃশংসতাকে মনে পড়াইয়া দেয়। তবে সমগ্র কাণ্ডটির চলচ্ছবি পরবর্তীকালেও উপভোগ করার জন্য মোবাইল ক্যামেরা-ফোনে তুলিয়া রাখার মধ্যে যে পৈশাচিকতা আছে, তাহা হুনদেরও ছাপাইয়া যায়।
ছবি তুলিয়া রাখা না হইলে এবং চিত্রগ্রাহক জওয়ানের অনবধানে তাহা দেশময় বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত না হইলে হয়তো বিএসএফের ওই আট জওয়ানের কোনো শাস্তিই হইত না। শাস্তি যে হইবেই, হলফ করিয়া সে কথা বলাও যায় না। কেননা অতীতেও বহুবার বিএসএফের হাতে পাচারকারী সন্দেহে নিরীহ গ্রামবাসীদের গুলি করিয়া হত্যা করার ঘটনা ঘটিয়াছে। এমনকি দরিদ্র গৃহবধূ ধর্ষণে বাধা দিলে তাহাকেও যৌনবুভুক্ষু নরপশুদের একইভাবে হত্যা করার ঘটনা বিরল নয়। জানাজানি হইয়া গেলে কিংবা স্থানীয় জনসাধারণ বিক্ষুব্ধ হইয়া পড়িলে প্রতি ক্ষেত্রেই মিথ্যা অভিযোগ সাজাইয়া নিজেদের অপকর্ম ও নিষ্ঠুরতার সাফাই গাওয়ার চেষ্টা হয়। 'সাসপেন্ড' জওয়ানরা অচিরেই কর্তব্যে বহাল হয়, তাহাদের হাজতবাস কিংবা কঠোরতর কোনো শাস্তি পাওয়ার কথা আজ পর্যন্ত কখনও শোনা যায় নাই। লক্ষণীয়, বিএসএফ জওয়ানরা নিজেরা তথাকথিত পাচারকারীদের 'দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি' দিতেই এমন ববর্রতায় লিপ্ত হওয়ার কথা বলে। অথচ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তাহাদের নিজেদেরই পাওয়ার কথা, যাহাতে ভবিষ্যতে আর কোনো জওয়ান এমন আচরণ করার স্পর্ধা না দেখায়। শুধু বিএসএফ নয়, ক্ষমতাশালী মাত্রেই ভারতীয় সমাজে ক্ষমতাহীনদের সহিত এ ধরনের নিষ্ঠুরতায় লিপ্ত হইতে উৎসাহিত হয়। দরিদ্রের ওপর ধনীর অত্যাচার, পরাজিত দলের সমর্থকদের ওপর বিজয়ী দলের সমর্থকদের অত্যাচারে একই প্রবণতা লক্ষণীয়। পুলিশ, সেনাবাহিনী, আধা-সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ হওয়ার সুবাদে জনসাধারণের বিভিন্ন অংশের ওপর স্থায়ীভাবে শোষণ-নির্যাতন চালাইবার অধিকারে পুষ্ট। দেশে কিন্তু 'আইনের শাসন' বলবৎ থাকার কথা। তদনুযায়ী কোনো অপরাধী বা অভিযুক্তকেই পুলিশ, সেনা বা আধা-সেনা নিজেরা কোনো শাস্তি দিতে পারে না। অপরাধ শাস্তিযোগ্য কি-না এবং শাস্তির পরিমাণ কী, দুই-ই নির্ধারণ করার এখতিয়ার বিচার বিভাগের, আদালতের। পুলিশ বা বিএসএফ বড়জোর অভিযুক্তকে গ্রেফতার করিতে পারে। তাহার পর ধৃতকে আদালতে হাজির করা এবং তাহার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ করার দায় আছে। আইন নিজ হাতে লইয়া অভিযুক্তকে অপরাধী সাব্যস্ত করিয়া শাস্তি দিবার অধিকার ভারতীয় সংবিধান কাহাকেও দেয় নাই। বিএসএফ স্পষ্টতই আইন লঙ্ঘন করিয়াছে। অভিযুক্ত জওয়ানদের আড়াল করার চেষ্টা কিন্তু প্রকারান্তরে আইন ভঙ্গকারীদের আড়াল করারই চেষ্টা। ধামাচাপা না দিয়া দ্রুত ওই সাসপেন্ড জওয়ানদের বিচারের সম্মুখীন করা হউক এবং অপরাধ প্রমাণে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হউক।
সম্পাদকীয়, আনন্দবাজার, ২০ জানুয়ারি, ২০১২

No comments

Powered by Blogger.