মূল রচনা-বারীর কাজ বীরের মতো! by শহিদুল ইসলাম ও মাহফুজ রহমান

শিক্ষাসফরে যাচ্ছিল বাসটি। ভেতরে ছিল ৪০ জন ছাত্রী, একজন শিক্ষক—মো. তোহিদুল বারী। আচমকা সামনের একটি বাসের পেছনে ধাক্কা দিয়ে বসে বাসটি। মুহূর্তেই পাশের গভীর খাদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে বেয়াড়া সে যান! পালিয়ে যান বাসের চালক! চালকের আসনে বসেন বারী।


তারপর? জানাচ্ছেন পঞ্চগড় প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম ও মাহফুজ রহমান ঘটনাটি ঘটেছিল গেল বছরের ১০ জানুয়ারি। আমরা ‘ঘটনা’ বলছি, মো. তোহিদুল বারী না থাকলে হয়তো সেটাকে ঘটনা বলা হতো না, বলতে হতো দুর্ঘটনা!
সেদিন পঞ্চগড় মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ বেরিয়েছিল শিক্ষাসফরে। গন্তব্য ছিল নওগাঁর পাহাড়পুর। দুটি মিনিবাসে ছিল ৮০ জন ছাত্রী আর দুজন শিক্ষক। বাস ছাড়ার আধা ঘণ্টা বাদে দুর্ঘটনায় পড়ে পেছনের বাসটি। সামনের একটি বাসের পেছনে ধাক্কা দিয়ে খাদের কিনারে চলে যায় মুহূর্তের মধ্যে! বাসের ভেতর শুরু হয় আহাজারি। বাসের চালকের কানে যায় না সেসব, হয়তো যায়ও। চরম স্বার্থপরতার নজির রেখে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পালিয়ে যান তিনি বাস থেকে! কী হবে এখন? সামনে কি মৃত্যু? বাসের ভেতরের সব মানুষের চোখে-মুখে-মনে একই প্রশ্ন। ঠিক সেই মুহূর্তে বাসের চালকের আসনে বসে পড়েন মো. তোহিদুল বারী। সবার কাছে যিনি পরিচিত বাবু স্যার নামে। পঞ্চগড় মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক তিনি। শখের বশে মাঝেমধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি চালিয়েছেন বটে। তবে মিনিবাসের স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখার অভিজ্ঞতা ছিল না কখনই। তার পরও কেবল ছাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে আর এক বুক সাহস নিয়ে তিনি হাত রাখলেন স্টিয়ারিংয়ে, ব্রেকে পা। অবশেষে বাসটাকে বাগে আনতে পারলেন বারী। বাসের দুটি চাকা ততক্ষণে শূন্যে ঝুলে গেছে। নিচে গভীর খাদ। হাফ ছেড়ে বাঁচল সবাই, নিশ্চিত একটা দুর্ঘটনা বাঁক নিল দুঃসাহসী এক ঘটনার দিকে।
প্রায় এক বছর বাদে, এ বছরের ৪ জানুয়ারি তোহিদুল বারীকে সম্মাননা জানাল পঞ্চগড় জেলা শিক্ষা কার্যালয়। এই সম্মাননা পাওয়ার চেয়ে জীবন বাঁচানোর আনন্দটাই বড় তাঁর কাছে, ‘সম্মাননার চেয়ে ওই মুহূর্তের আনন্দটাই আমার বড় পাওয়া হয়ে থাকবে আজীবন!’ ছাত্রীরা বলছেন, ‘স্যার ছিলেন বলেই নিশ্চিত একটা দুর্ঘটনা থেকে ফিরে এসেছি আমরা!’ ৪ জানুয়ারির খবরটা ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোয়। সেদিন অনলাইনে সর্বোচ্চ পঠিতব্য তালিকায় দ্বিতীয় স্থানটি দখল করেছিল খবরটি। পাঠক মন্তব্য করেছিল ৯৪টি। সেখানে এক পাঠক লিখেছেন, ‘বারীর কাজ বীরের মতো!’

স্যারেরা দিলেন সারপ্রাইজ
কদিন ধরেই একটা প্রশ্নই ঘুরছিল সবার মাথায়, ‘এবার কোথায় যাচ্ছি আমরা?’ উত্তর অজানা। প্রশ্নটা মাথায় নিয়েই সবার প্রস্তুতি শুরু। সবাই বলতে পঞ্চগড় মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের ৮০ জন ছাত্রী। শিক্ষাসফর বলা হলেও আসলে তো তাতে বনভোজনেরও ঘ্রাণ মিশে ছিল অনেকখানি—এ কথা ছিল সবারই জানা। তাই শিক্ষাসফরের দিন কী করা হবে, কী করা হবে না, তা নিয়ে তুমুল উৎসাহ-উদ্দীপনা সবার মধ্যে। ছাত্রীদের কেউ থাকেন বাড়িতে, কেউ কেউ কলেজ হোস্টেলে। তারপর এসে গেল দিনটা, ১০ জানুয়ারি সোমবার। কুয়াশার দাপট খানিকটা কমে আসতেই সবাই এসে জড়ো হলেন কলেজের পেছনের বড় মাঠটাতে। দুটি মিনিবাস দাঁড়ানো সেখানে। আর সবকিছু প্রস্তুত। চারপাশে উৎসবের আমেজ।
ঘড়িতে তখন আটটা। ৪০ জন করে মোট ৮০ জন ছাত্রী উঠলেন বাস দুটিতে। এর মধ্যে আবার বাসের আসনে টান পড়ায় তিন-চারজন বসে পড়লেন বাইরে থেকে নিয়ে আসা অস্থায়ী চেয়ারে! ভ্রমণের উত্তেজনায় সামান্য এই কষ্ট পাত্তাই পেল না! হাসি সবার মুখে। প্রথম বাসটিতে ছাত্রীদের সঙ্গে থাকলেন কলেজের সহকারী অধ্যাপক গোলাম কিবরিয়া। পেছনেরটিতে তোহিদুল বারী। যাত্রা হলো শুরু। শুরু হলো হইহল্লা—হিপ হিপ হুররে! মজার ব্যাপার, ছাত্রীরা তখনো জানেন না তাঁদের গন্তব্য কোথায়! নাটকীয় ভঙ্গিতে আসন ছেড়ে উঠলেন বারী স্যার, ‘তোমরা কি জানো, আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ সমস্বরে উত্তর এল, ‘না স্যার, জানি না!’ ‘আমরা একটা ঐতিহাসিক জায়গায় যাচ্ছি!’ কেউ কেউ আঁচ করে ফেললেন গন্তব্যস্থলের ঠিকানা। অবশেষে মুখ ফুটে নামটা বলে দিলেন বারী স্যার, ‘আমরা যাচ্ছি নওগাঁর পাহাড়পুরে!’ ঘোষণা শেষ হতে না হতেই বাসে যেন কান পাতাই দায় হলো, শুরু হলো ফের ‘হিপ হিপ হুররে! যাই পাহাড়পুর রে!’ চালকের পাশে একটা অস্থায়ী চেয়ারে বসে বসে ছাত্রীদের আনন্দ দেখে হাসেন তোহিদুল বারী।
বাস চলছে। অনেক দূরে তাকালে কেবল কুয়াশার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। খানিক বাদে বাদে চোখে পড়ে রাস্তার দুই ধারের হলুদ সরষেখেত। ধান কাটা হয়ে গেছে। ফাঁকা মাঠে খড়ে আগুন লাগিয়ে বসে আছেন ছেলে-বুড়ো সবাই। চমৎকার একটা দিন। কিন্তু বাসের ভেতরও তো চমৎকার একটা আবহাওয়া চাই! তাই পেছন থেকে কয়েকজন অনুরোধের আসর বসাল বাসচালকের কাছে, ‘ড্রাইভার ভাই, গান বাজান না!’ চালকের বয়স খুব বেশি নয়। কলেজপড়ুয়া ছাত্রীদেরই সমবয়সী। সমবয়সীদের কথা পাশ কাটিয়ে দিব্যি স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে চললেন তিনি! নাছোড় ছাত্রীরা ফের আবদার তুললেন, ‘চালান না ভাই, একটা গান!’ কে শোনে কার কথা। নাখোশ সবাই। নাখোশ হলেও আনন্দ তো আর থেমে থাকে না। ছাত্রীরা যাঁর যাঁর মুঠোফোন বের করে চালিয়ে দিলেন গান, ‘আহা, কী আনন্দ আকাশে বাতাসে...!’
ততক্ষণে কেউ কল্পনাও করেননি সামনে ঘাপটি মেরে আছে নিরানন্দ!

ঘটনার আগে দুর্ঘটনা
হঠাৎ কী হলো, পেছনের বাসের সবাই একদম চুপ মেরে গেল! গানটান সব বন্ধ! নাশতার প্যাকেটগুলো অবশ্য খালি হয়েছে এরই মধ্যে। কোথায় বাড়তি উদ্দীপনা কাজ করবে, তা না! উল্টো যেন নাশতা-ঘুমে চলে গেলেন সবাই! সবার নীরবতা ভাঙল বাসচালকের আনাড়িপনায়! রাস্তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল একটা খড়বোঝাই ভ্যান। আচমকা সেটাকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন চালক! ভ্যানের খড় তো পড়ে গেলই, পড়ে গেলেন ভ্যানচালকও। বেচারা উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বাস পগারপার! এতেও কি শিক্ষা হয়! হয় না, তা প্রমাণ করলেন তরুণ চালক। কিছুদূর গিয়েই আরেকটা ভ্যানকে ধাক্কা মেরে বসলেন দ্বিতীয়বারের মতো! যারপরনাই বিরক্ত সবাই। কিন্তু চলন্ত অবস্থায় তো চালককে আর ধমকানো যায় না। তাই বারী বুঝিয়ে বললেন, ‘ধীরে, সাবধানে চালাও না ভাই!’ চালকের কোনো বিকার নেই। ভাব-গতিও বিশেষ সুবিধার না!

খাদের মুখে বেয়াড়া বাস
ঘড়িতে তখন ১০টা পেরিয়েছে। সামনের রাস্তাটা বেশ উঁচু। বোঝাই যাচ্ছিল কোনো সেতু-টেতু হবে। পরে বোঝা গেল, হ্যাঁ নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে দিনাজপুরের ঢেপা নদী। তার ওপর সেতু। সামনে ছিল একটা বিআরটিসির বাস। প্রথম বাসটা সেটাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল সামনে। চকিতেই ব্রেক কষলো বিআরটিসির বাসটি। প্রবল একটা ঝাঁকুনি খেয়ে বসল পেছনের বাসের সবাই! হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন কেউ কেউ সামনে।
ঝন ঝন করে একটা শব্দ হলো, ভেঙে গেছে বাসের সামনের কাচ। বোঝাই যাচ্ছে, বাসটাকে বাগে আনতে পারছেন না চালক। কী হবে এখন? বাসের ভেতরের সবারই চোখ বস্ফািরিত। আতঙ্কে শুরু করল চিৎকার, ‘বাঁচাও, বাঁচাও!’ চালকের দৃষ্টি উদ্ভ্রান্তের মতো। বাসের একটি চাকা ততক্ষণে পাশের গভীর খাদের দিকে ধাবমান। পেছনে ৪০ জনের আহাজারি। মাথা ঠিক নেই তাঁর। মেঝেতে পড়ে গিয়ে বেকায়দায় পড়ে আছেন দুজন ছাত্রী। তাঁদের ওপর পা রেখেই জানালার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি! চালকের মতলব আঁচ করলেন বারী স্যার, ‘ড্রাইভার, যাও কোথায়! বাস কে সামলাবে?’ কে শোনে কার কথা! চালক ততক্ষণে লেজ গোটাতে শুরু করেছেন। বারী ছাত্রীদের বললেন, ‘অ্যাই, থামাও ব্যাটাকে, যেতে দেবে না বাইরে!’ আতঙ্ক এমন সর্বগ্রাসী, সবাই তখন তাঁর কাছে পরাভূত! কেউই পারলেন না চালককে পলায়ননীতি থেকে সরিয়ে নিয়ে আসতে! সবাই চেয়ে চেয়ে দেখলেন, জানালা গলে নেমে পড়িমরি করে ছুটছেন চালক। পেছনে আহত প্রাণীর মতো গর্জন করছে বাস। গভীর খাদের মুখে পেটে ৪০ জনের কিছু বেশি মানুষ নিয়ে! আক্ষরিক অর্থেই পড়িমরি করে ছুটতে লাগলেন স্বার্থপর চালক। একটা সরষেখেতে নেমে গেলেন তিনি, এই পড়েন, এই ওঠেন—আবার দৌড় লাগান। একসময় তিনি ঢুকে গেলেন একটা
জঙ্গলের পেটে! এরই মধ্যে কেটে গেছে মিনিট খানেক সময়।
বাসের ভেতরের আহাজারি সংক্রমিত সবার মধ্যে। কেবল মাথা ঠান্ডা রাখলেন একজন—তোহিদুল বারী। তাঁর ১৮ বছরের শিক্ষক জীবনে এমন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি তিনি কখনই হননি। গোটা জীবনেও কী হয়েছিলেন? হয়তো না, কারণ ততক্ষণে টের পেয়েছেন, তাঁর ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু! ব্যক্তিগত গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল। ঢেলে দিলেন সেই অভিজ্ঞতার পুরোটাই। পা রাখলেন ব্রেকে, হাত স্টিয়ারিংয়ে। শরীরের সব শক্তি দিয়ে চেপে ধরলেন ব্রেক। ঘটনা ঘটতে লাগল দ্রুত। ২৫-৩০ গজ দূরে গিয়ে অবশেষে শান্ত হলো বাসটি। বেয়াড়া বাসের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলেন বারী। লম্বা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল বুকের গভীর থেকে!

স্যারের জন্য ভালোবাসা
বিশাল একটা ফাঁড়া কাটার পর সেদিন ঠিকই শিক্ষাসফর হলো। একজন অবশ্য গাইগুঁই করেছিলেন। কিন্তু বাকি সবার উৎসাহের জোয়ারে ভেসে গেল সেই আপত্তি। দিনভর চলল উৎসব। বেঁচে থাকা যে কতটা আনন্দের, তা যে ততক্ষণে সবাই উপলব্ধি করেছেন! আনন্দের মধ্যমণি হয়ে রইলেন তোহিদুল বারী। ‘থ্রি চিয়ার্স ফর বাবু স্যার!’
১৯৯২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেন বারী। পরের বছর যোগ দেন পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজে প্রভাষক হিসেবে। এখন তিনি ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের প্রধানও। এ ছাড়া দায়িত্ব পালন করছেন কলেজের পাথর জাদুঘরের অবৈতনিক কিউরেটর হিসেবেও। পঞ্চগড় জেলা পরিবেশ পরিষদের সভাপতি বারীর বাড়ি পঞ্চগড় শহরের ডোকরো পাড়ায়। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে তাঁর ছোট্ট সংসার।
সেদিন বাসের ৪০ জনের মধ্যে ছিলেন সামিরা আক্তার, জয়তুন নাহার, জাকিয়া আকতার, শান্তা ও পান্নারা। এঁদের সঙ্গে কথা হলো আমাদের। সবারই কণ্ঠে বারী স্যারের জন্য ভালোবাসার প্রকাশ, ‘স্যার যে সাহসিকতা সেদিন দেখিয়েছেন, তার তুলনা হয় না। ওই সাহসিকতার পেছনে আমাদের জন্য স্যারের ভালোবাসাবোধই বেশি কাজ করেছিল। স্যারের জন্যও আমাদের শুভকামনা।’ আর ঘটনার নায়ক বারী কী বললেন? বললেন, ‘আসলে ওই সময় তো অত কিছু ভাবার অবকাশ ছিল না। কেবল ছাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝে নিয়েছেন, যে করেই হোক বাসটা থামাতে হবে আমাকে। বাসটা থামানোর পর ছাত্রীদের চোখে যে আনন্দ দেখেছি, সেটাই আমার বড় পাওয়া।’

No comments

Powered by Blogger.