আহা! বৈদেশে আমরা কতই না সুখে আছি by রীতা রায় মিঠু

সেদিন এক বন্ধুকে ফোন করেছিলাম। নতুন বন্ধু, ফেসবুকের সূত্র ধরেই বন্ধুত্ব হয়েছে। বন্ধু আমার মিডিয়ায় বেশ পরিচিত উজ্জ্বল মুখ। বাম রাজনীতিঘেঁষা একটু, তাই শুরুতেই আমার আমেরিকা থাকা নিয়ে একটা খোঁচা মেরেছে। আমি তো হাসি, আরো অনেকেই আমাকে এমন খোঁচা মারে।


আমার এই নতুন বন্ধু কম খোঁচা মেরেছে, অনেকে তো আরো কঠিন আঘাত করে। যেন বুশ বা ক্লিনটন বা ওবামা যা সিদ্ধান্ত নিতেন বা নিচ্ছেন, তা বুঝি আমার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই করেন। তারা আমাকে সুযোগ পেয়ে শুনিয়ে দেয়, এই শ্রেণীশত্রুদের কাছে মাথা নোয়ানোর চেয়ে দেশের খেটে-খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ানো অনেক সম্মানের। আমি আবারও হাসি। এই হাসি বিদেশি হাসি; অনেক যত্নে আমি অনুশীলনের মাধ্যমে এটি আয়ত্ত করেছি। মুখে হাসি ধরে রাখতে পারলে অনেক অপ্রিয় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়। বিদেশের পথে মার্কেটে এর মূল্যই আলাদা। এটা সৌজন্যবোধের অংশ। যখন অনেক ছোট ছিলাম, সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি, সাধারণ চাকরিজীবী বাবা সব দিক সামলে শেষ পর্যন্ত আর পেরে উঠতেন না হিসাবের বাইরে কিছু করার। তাই স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন, সেই স্বপ্ন দেখতে গিয়েই কখন যে মনের অজান্তে বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতে শুরু করেছি, এখন আর তা মনে পড়ে না। শুধু একটা দিনের ছোট্ট একটা ঘটনা মনে আছে। আমি যখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি, স্কুল থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলাম আরেক মেয়ের সঙ্গে, তাকে আমি বলছিলাম যে একদিন আমি বিদেশে যাবই যাব। সেই মেয়েটি কিন্তু সত্যিই বিশ্বাস করেছিল যে এক দিন আমি বিদেশে যাব। মনে আছে, স্বাধীনতার পর সোভিয়েত ইউনিয়নে ছাত্রছাত্রীদের যাওয়ার ধুম পড়ে গিয়েছিল। বিয়ের আগে আমার হবু বরের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে এক দিন বলেছিলাম, আমার খুব বিদেশে যাওয়ার শখ (নির্দিষ্ট কোনো দেশের নাম বলতাম না, শুধুই বিদেশ যাব বলতাম)। তখন থেকেই মনে হয় আমার স্বামী ভেবে রেখেছিলেন যে আমাকে বিদেশ দেখাবেন। যদিও আমার স্বামী গ্রামের ছেলে, গ্রামেই শৈশব কেটেছে, তাহলেও সে গ্রামের বাড়িতে থেকেই আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল এবং অসম্ভব মেধার জোরে সে ঠিকই আমেরিকা গিয়েছিল। আমেরিকার প্রতি তার ভীষণ দুর্বলতা ছিল (এখনো আছে); তবে সে দেশের ধনভাণ্ডারের প্রতি কোনো ভক্তি না, সে দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতি দুর্বলতা, সে দেশে জন্মানো মনীষীদের প্রতি দুর্বলতা। যা হোক, আমার স্বামী আমাকে প্রথম সত্যিকারের বিদেশ বলতে নিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়ায়। আমি যেমন কেউ বিদেশে থাকে শুনলেই মনে করতাম, তারা কতই না সুখে আছে, আমাদের বেলায়ও এমনটা ভাবার লোকের অভাব হয়নি। অনেকে তো মুখের ওপর আমার সৌভাগ্য নিয়ে নানা রকম কৌতুক করতে শুরু করেছিল। তারা তখন ভুলেই যেত, বিয়ে না হলেও আমার নিজের যোগ্যতায়ই উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে যাওয়ার মতো ক্ষমতা আমার ছিল। গায়ে মাখতাম না লোকের কথা, অনেকের মনে ধাক্কা দিয়ে আমি স্বামীর সঙ্গে চলে গেলাম অস্ট্রেলিয়া, সঙ্গে দুই মেয়ে। কিন্তু প্লেন থেকে নেমেই মেলবোর্নের প্রচণ্ড শীতের এক ঝাপ্টা খেয়ে চমকে উঠে আমার স্বপ্নের বিদেশের মাটিতে পা রাখলাম। এবার আমি সব জেনেবুঝেই এসেছিলাম আমেরিকায়, জানতাম আমার ভালো লাগবে না। সত্যি আমার ভালো লাগে না। ১০ বছর ধরে আছি, এমনিতে খাওয়া-পরার অভাব নেই, বিলাস-ব্যসনের অভাব নেই কিন্তু কোনো কিছুতেই সুখ যে নেই! অস্ট্রেলিয়ায় থাকার সময় দেশে ফোন করতাম মাসে একবার, অনেক এঙ্পেনসিভ ছিল, কিন্তু এখানে এখন ফোন করা আগের মতো ততটা কঠিন ব্যাপার নয়। এখন তো আরো সুবিধা হয়ে গেছে স্কাইপ থাকায়। জীবন অনেক সহজ হয়ে গেছে। তবু কেন ভালো লাগে না! কাজে আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করে আমার এখানে কেমন লাগছে! তারা অনেক আশা নিয়েই আমাকে জিজ্ঞেস করে যেন আমি বলব, আমার খুব ভালো লাগছে এখানে। কিন্তু আমি তা বলি না, আমি সরাসরি বলে দিই, আমার এখানে ভালো লাগছে না। একটুও না।
আমার সেই বন্ধুটি আমাকে বইমেলায় যেতে বলেছে। সে না বুঝেই আমাকে বইমেলার কথা বলে ফেলেছে। সেই থেকে আমার কিছু ভালো লাগছে না, এ মাসেই দূর্গাপুজা গেল। ১০ বছর ধরে দেশে থেকে পূজা উদ্যাপন করা হয় না। আমরা এখানে কাজের ছুটি, ভেন্যুর নিশ্চয়তা দেখে পূজার দিনক্ষণ ঠিক করি। এক দিনেই ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী পূজা সেরে ফেলি। সবাই ব্যস্ত, সকালে উঠেই কাজে যেতে হয়। আয়োজন করি ঠিকই, কিন্তু আনন্দ পাই না। মনে হয়, যেন খুব আরোপিত আনন্দ! কিন্তু দেশে মা-বাবাকে বলি, আমরা এখানে খুব আনন্দ করছি। বলি, কারণ যাতে তাঁরা তাঁদের সময়টুকু আনন্দে কাটাতে পারেন। ঈদের বাজার, পূজার বাজার করা থেকেই তো শুরু হয় উত্তেজনা। আমরা বাজার করব কী, এখানে ঈদ বা পূজায় দিনক্ষণ ঠিক করতে গিয়ে জামা-কাপড় কেনার কথা ভুলে যাই। নতুন থাকলে ভালো, না হলে পুরনো কাপড় দিয়েই চালিয়ে দিই। সাতসকালে উঠেই কাজে যেতে হয়, ফিরতে ফিরতে রাত হয়। কখনো কখনো যে একটু আয়েশ করে, দেরি করে কাজে যাব, সে উপায় নেই। আমাদের এখানে যান্ত্রিক জীবন। উঠতে-বসতে থ্যাঙ্ক ইউ, সরি করতে করতে ঘুমের মধ্যেও থ্যাঙ্কস-সরি বলে ফেলি। কাজে দেরি করে যাব, সে উপায় নেই। লেট মার্ক পড়ে যাবে। চাকরির বাজার মন্দা, যে কোনো দিন চাকরি চলে যাওয়ার ভয়। ঘুম থেকে উঠেই জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত সব নিজেকে করতে হয়। বাচ্চাদের মুখে আধো উচ্চারণে বাংলা শুনতে হয়, জোর করে দেশি খাবার খাওয়াতে হয়, নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হয়, যাতে বাচ্চারা নিজেদের শেকড় হারিয়ে না ফেলে।
আরেকটা যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার আছে, সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়, এই বুঝি দেশ থেকে কোনো খারাপ সংবাদ এল। আমাদের তো দেহটাই শুধু পড়ে থাকে বিদেশের মাটিতে, মনটা তো সারাক্ষণ দেশের আনাচে-কানাচেই ঘুরে বেড়ায়। আসলে কেউ জানে না আমরা এখানে কেমন থাকি। দেশে সবাই জানে এবং বিশ্বাস করে, ডলারের মোহে আমরা এখানে পড়ে আছি। রাজনীতিবিদরা বক্তৃতা দেওয়ার সময় শুধু বলেন, আমাদের পাঠানো টাকায় দেশের বৈদেশিক আয়ের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, কিন্তু বলেন না, আমরা দেশের বাইরে থাকায় দেশের ওপর এত মানুষের চাপ কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে। অনেক শখ ছিল বিদেশ আসার, শখ পূরণ হয়েছে। কিন্তু কী যেন হারিয়ে গেছে, খুঁজি আর খুঁজি। কিন্তু এমন কোথাও হারিয়ে গেছে যে আর এই জীবনেও খুঁজে পাব না। আমাদের মনের অবস্থা অনেকটাই এমন, 'আমার সুখ নেইকো মনে, নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে হলুদ চাঁপার বনে'।
লেখক : প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.