সময়চিত্র-যে বিচার করতেই হবে by আসিফ নজরুল

জাহানারা ইমাম মারা যান ২৬ জুন ১৯৯৪ সালে। মরণব্যাধি ক্যানসারের যাতনা নিয়ে তিনি সারা দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এই বিচার দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর। তিনি মারা যাওয়ার কিছুদিন আগ থেকে বরং এই দাবিতে শামিল কিছু রাজনৈতিক দল পিছুটান দেওয়া শুরু করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি প্রায় বিলীন হতে থাকে পরের প্রায় এক যুগ।


বাংলাদেশের মানুষকে নিষ্ঠুর কিছু দৃশ্য দেখতে হয় এ সময়ে। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ব্যাপকভাবে অভিযুক্ত জামায়াতের নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ মন্ত্রী হন ২০০১ সালে গঠিত বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারে। যে বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিলেন, সেই দেশের পতাকা উড়িয়ে পাঁচ বছর তাঁরা ঘুরে বেড়ান রাজকীয়ভাবে। ১৯৭১ সালে স্বজনহারা পরিবারের মনে কেমন কষ্ট লেগেছিল তখন! আমার শুধু মাঝেমধ্যে মনে হতো, ভালো হয়েছে, জাহানারা ইমামকে দেখতে হয়নি এসব দৃশ্য। তিনি মারা যাওয়ার দিন ট্রাকে করে তাঁর মৃতদেহ নেওয়া হচ্ছিল মিরপুরে। সেখান থেকে অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে দেখি, সংসদ চত্বরের দেয়ালে লেখা ‘হৈ হৈ রৈ রৈ জাহানারা ইমাম গেলি কই!’ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা মন্ত্রী হওয়ার সময়ে বেঁচে থাকলে না জানি আরও কত অপমান সইতে হতো তাঁকে!
সেই অপরাধীদের বিচার শুরু হলো অবশেষে, আমি কেন লিখি না কিছু? কিছু ঘনিষ্ঠজন এ নিয়ে অনুযোগ করেন আমার কাছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আগের আওয়ামী লীগ আমলে লিখেছি, এমনকি বিগত বিএনপি সরকারের আমলে প্রথম আলোতেই লিখেছি। তাহলে এখন কেন লিখছি না? আমার শুধু মনে হতো, বিচার তো হচ্ছেই, অনেকে এখন লিখছেন। টিভির দর্শক পত্রিকার পাঠকের চেয়ে বেশি, টেলিভিশন টক শোতে এ সরকারের আমলে বহুবার এই বিচারের উদ্যোগকে সমর্থন করেছি। এসব ভেবে লেখার প্রয়োজন অনুভব করিনি সেভাবে। কিন্তু বিএনপির নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের একটি বক্তব্যের পর কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছে, এ নিয়ে লেখার প্রয়োজন আছে।
ব্যারিস্টার মওদুদ সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবি করেছেন। মানুষের সমালোচনা দেখেই হয়তো বিএনপির পক্ষ থেকে পরে তা আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর এই দাবির কথা অনেকের পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে, আমার মতো ব্যক্তিদের, যাঁরা আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে বিচারের কথা বলেন, আওয়ামী লীগ আদৌ আগামী নির্বাচনের আগে এই বিচার শেষ করবে কি না, সে নিয়ে সন্দেহের কথা বলেন। আমাদের স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন, এসব কথা বলার মানে এই নয় যে আমরা বিচারের প্রয়োজন সামান্যতমও অস্বীকার করছি। বরং অত্যন্ত জোরালোভাবে বলা প্রয়োজন, এই বিচার হতেই হবে এবং তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ততই ভালো।

২.
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশে বহু ভালো গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এর মধ্যে খুব কম গ্রন্থ রয়েছে, যেখানে রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীর অমানুষিক কর্মকাণ্ডের বিবরণ নেই। একাত্তরে এত বেশি খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ কখনোই সংঘটিত হতো না, যদি বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নিয়ে এসব বাহিনীর মানুষগুলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ না করত, রক্তলোলুপ পাকিস্তানি বাহিনীকে উসকে না দিত, তাদের সর্বতোভাবে সহায়তা না করত। পৃথিবীর কোনো দেশে, কোনো আইনে এ ধরনের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষমা করার বিধান নেই। শুধু কোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া নয়, কেবল ক্ষুদ্র কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, এসব অপরাধের বিচার করতে হয় ঐতিহাসিক অন্যায়কে চিহ্নিত করার জন্য, জাতির ইতিহাসের কলঙ্ক মোচনের জন্য, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে জাতিগত দায়বদ্ধতা পালনের জন্য।
দেশের জন্য যাঁরা অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের হত্যাকারীদের শাস্তির বিধান করতে না পারলে জাতি হিসেবে আমাদের আত্মসম্মান, মর্যাদাবোধ ও অহংকারই বা থাকে কোথায়। দয়াপরবশ হয়ে বঙ্গবন্ধু দালাল আইনে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের ক্ষমা করেছিলেন। কিন্তু খুন, ধর্ষণ, ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত মানুষকে তিনি কখনো ক্ষমা করেননি। তাদের বিচারের জন্য তিনি ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন নামের একটি আইন প্রণয়ন করেছিলেন। আইনে পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়ক বাহিনীগুলোর সদস্য হিসেবে একাত্তরের হত্যাযজ্ঞে জড়িত রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যদের বিচারের বিধান রয়েছে। প্রায় ৩৮ বছর পর ১৯৭৩ সালের আইনটির অধীনে বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার। এই বিচারের ঘোষণা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল, নির্বাচনী ওয়াদাতে উচ্চারিত হয়েছিল। এই বিচার বন্ধের দাবি করার কোনো নৈতিক অধিকার অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেই।
১৯৭৩ সালের আইনটির কিছু দুর্বলতার সমালোচনা দেশে-বিদেশে হয়েছে। এর সুযোগে বিএনপির কোনো নেতা বা অন্য কেউ বিচার বন্ধের দাবি করলে তা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করা ছাড়া আর কিছু নয়। সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কারণে উদ্ভূত মানুষের অসন্তোষ ব্যবহার করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঐতিহাসিক দায়কে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করাও কোনোভাবেই সমর্থনীয় নয়। বর্তমান সরকার সবচেয়ে ভালো যে কয়েকটি কাজ করেছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ এবং বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন। এই উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় দুর্বলতা এবং ভুলত্রুটি থাকলে তা বলার অধিকার যে কারও থাকতে পারে। কিন্তু এসব গঠনমূলক সমালোচনার সুযোগে ট্রাইব্যুনাল বিলোপ করার বিভ্রান্তিমূলক দাবি যারা করবে, তাদের রুখে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সবাইকে অবশ্যই পালন করতে হবে।

৩.
আইনশাস্ত্রে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধ আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। এই স্বীকৃতির মানে হচ্ছে, অপরাধগুলোর বিচার সংশ্লিষ্ট দেশ করতে অসমর্থ বা অনিচ্ছুক হলে অন্য কোনো দেশও বিচারটি করতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই বিচার নিশ্চিত করার জন্য রোম সংবিধি অনুসারে ২০০২ সালে নেদারল্যান্ডে একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠন করা হয়েছে। শেখ হাসিনার প্রথম সরকার এই সংবিধিতে স্বাক্ষর করেছিল, বর্তমান সরকার এটি অনুসমর্থন করেছে। ফলে এই বিচার করা বাংলাদেশের জন্য একটি আন্তর্জাতিক দায়িত্বে পরিণত হয়েছে।
তবে রোম সংবিধির পক্ষ হওয়াতে ১৯৭৩ সালের আইনটি যুগোপযোগী করার আবশ্যকতাও সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৭৩ সালে আইনটি করা হয়েছিল সমসাময়িক আন্তর্জাতিক আইনের মানদণ্ডে, সে সময়ের বিশ্বখ্যাত আইনজীবীদের সহায়তা নিয়ে। তখনকার প্রেক্ষাপটে এই আইন ছিল উৎকৃষ্ট একটি আইন। কিন্তু গত কয়েক দশকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের নীতি, পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের বেশির ভাগ পরিবর্তন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনগত অধিকার বৃদ্ধি করেছে মূলত ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করার কথা বলে। বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে আইনটির সংস্কার করে এসব পরিবর্তনের সবকিছু আইনটিতে ধারণ করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেসব প্রভুরাষ্ট্র আমাদের এসব পরিবর্তনের উপদেশ দিয়ে বেড়াচ্ছে, তারা নিজেরাই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে গুরুতর অপরাধের বিচার করে না। কিন্তু বাংলাদেশ সেসব রাষ্ট্রের মতো শক্তি, বিত্ত ও ক্ষমতার অধিকারী নয়। ফলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড যতটুকু পালন করা বিচারের কাজে অন্তরায় সৃষ্টি করবে না, তা মেনে ১৯৭৩ সালের আইনটির সংস্কার করলে তা ভালো হতো।
আমি কয়েকটি ব্যাখ্যা দিচ্ছি এখানে। যেমন, রোম সংবিধি অনুসারে মানবতাবিরোধী অপরাধের শর্ত হচ্ছে অপরাধটি পরিকল্পনামাফিক ও ব্যাপক (সিস্টেম্যাটিক অ্যান্ড ওয়াইডস্প্রেড) হতে হবে। আমাদের ১৯৭৩ সালের আইনে এই সংজ্ঞা গ্রহণ করলে অসুবিধা কোথায়? ১৯৭১ সালে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করে, রীতিমতো বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। কাজেই এটি অবশ্যই পরিকল্পনামাফিক হয়েছিল। আবার বহুসংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল বলে এটি অবশ্যই ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ছিল। কাজেই রোম স্ট্যাটিউটের এই সংজ্ঞা গ্রহণ করলে যাদের আমরা মানবতাবিরোধী অপরাধী হিসেবে জানি, তাদের বিচারে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে না। আবার রোম সংবিধিতে অপরাধীর বয়স নির্ধারণ করে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের অপরাধের দায় থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে। এই বিধান আমরা গ্রহণ করলে অসুবিধা কী? সরকার যাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গ্রেপ্তার করেছে, তাদের কেউই ১৯৭১ সালে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছিল না। তাহলে এ ধরনের আইনগত সংস্কার করলে সমস্যা কোথায়? যেসব সংস্কার করলে ক্ষতি নেই, তা করে সরকার বিশ্বব্যাপী এই বিচারের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়াতে পারত। শাদ, সিয়েরা লিয়ন, আর্জেন্টিনা, কম্বোডিয়াসহ অধিকাংশ দেশে এসব অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আইনের মানদণ্ড অনুসরণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের ১৯৭৩ সালের আইনটি বহুলাংশে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ধারণ করেছে। বিচারের ক্ষতি না করে এটি আরেকটু উন্নত করলে এই বিচার নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ কমে যেত।
আমাদের মনে রাখতে হবে, আমেরিকান বার অ্যাসোসিয়েশন এই আইন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল নিজেদের রিসার্চ থেকে এবং হয়তো যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের লবিংয়ের কারণে। এসব প্রশ্ন তোলার সুযোগ অনেকাংশে সংকুচিত করার সুযোগ থাকলে তা করা উচিত বলে আমি মনে করি।

৪.
বিচার নিয়ে অন্যান্য সমালোচনা আরও যৌক্তিক। ট্রাইব্যুনালের সরকারপক্ষের আইনজীবী ও তদন্তকারী দলগুলোর সক্ষমতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। এদের অবশ্যই আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজন ছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞদের আইনজীবীদের দলে কিংবা বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে সুদীর্ঘকাল ধরে গবেষণা করছেন যাঁরা, তাঁদের তদন্তদলে রাখলে কোনো সমস্যা হতো কি? বর্তমান ভবন পুরোপুরি খালি করে সেখানে একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা খুব দুষ্কর কি? বিচার কবে শেষ হবে, কোনো মন্ত্রী কর্তৃক এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দিয়ে বিচারকাজে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উসকে দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি? বিরোধী দলের সব কর্মসূচিকে ঢালাওভাবে বিচার বন্ধের ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করা সঠিক হচ্ছে কি? এসব প্রশ্ন সরকার যদি নির্মোহভাবে বিবেচনা করে, তাহলে তা বিচারের জন্য সহায়ক হবে। সরকারকে এ ধরনের গঠনমূলক পরামর্শ দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হবে।
আর যাঁরা বিচারের ঢালাও ও অযৌক্তিক সমালোচনা করেন, কিংবা বিচারকাজ বন্ধের স্বপ্ন দেখেন, তাঁদের সম্পর্কে আমাদের সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে। আমরা সেবাদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানের কিছু সমালোচনা সবসময় করি। তার মানে এই নয়, এসব প্রতিষ্ঠান আমরা তুলে দিতে বলি! যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আরও অনেক মহিমান্বিত প্রতিষ্ঠান। আমরা একে আরও শক্তিশালী বা আরও উন্নত করার কথা বলতে পারি, এর বিলোপের কথা নয়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হচ্ছে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছর পরও যদি এই বিচার সুসম্পন্ন না হয়, তাহলে এর গ্লানি অনন্তকাল ধরে আমাদের বহন করতে হবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.