এই দিনে-এই তো বিজয়!

হা্! যদি বিজয়ের ওই মুহূর্তটায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটা খোলা থাকত! ইশ্! যদি ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ গানটি সেদিনই শুনতে পেতাম নিজের কানে! আহা! যদি সে সময় উপস্থিত থাকতে পারতাম ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে! নিজ চোখে দেখতে পারতাম নিজের দেশের বিজয়ের মুহূর্তটি! সে সময়কার শিশু কিংবা বালক, তরুণ কিংবা যুবক, প্রৌঢ় কিংবা বৃদ্ধ—অনেকেরই মনের আক্ষেপ এটা।


নয় মাসই গুলির শব্দ শোনা গেছে এই বাংলায়। আতঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতায় দোলায়মান বাঙালির মনে সেই শব্দগুলো ছিল অবিমিশ্র। কখনো মনে হতো পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ চলছে বাংলার মাটিতে, কখনো মনে হতো মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে পাকিস্তানিদের ব্যুহ। একবার বিষাদ, একবার আনন্দে ভরে উঠত মন। কিন্তু এই দিনে, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে চারটার পর অস্ত্রের মুখ থেকে যে ভাষা বেরিয়েছে, তার নাম বিজয়ের আনন্দোল্লাস! মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁকা গুলিবর্ষণ আলোড়িত করেছে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসা লাখো মানুষকে।
দিব্যি মনে আছে, একজন মুক্তিযোদ্ধা চামেলীবাগে এসে কোলে তুলে নিয়েছিলেন পাঁচ বছরের এক শিশুকে, তারপর তাঁর হাতে থাকা স্টেনগানটির ট্রিগারে রেখেছিলেন শিশুটির কোমল আঙুল। সেই আঙুলের ওপর নিজের আঙুল রেখে একবারে শূন্য করে দিয়েছিলেন ম্যাগাজিন। শিশুটির কানে তালা লেগে গিয়েছিল। এখনো বিজয় বলতে সেই শিশু মনে করে ম্যাগাজিন শূন্য করে দেওয়া সেই উত্তেজনাটির কথা।
সেই শিশুই বিজয়ের আনন্দে অন্যদের সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে পুরো পাড়া প্রদক্ষিণ করে। ঘরে ফিরে দেখে ম্লানমুখ মাকে। মায়ের চোখে-মুখে-শরীরী ভাষায় বিজয়ের আনন্দ একেবারেই নেই। বাবাকে পাকিস্তানিরা নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই মায়ের মুখে আর হাসি নেই। বিজয় তখনো মাকে স্পর্শ করতে পারে না।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শেষে বড় ছেলে যখন বাড়ি ফেরে, তখন তাকে জড়িয়ে ধরে মা কাঁদতে থাকেন। এ যেন শ্রাবণের আকাশ থেকে ক্রমাগত বর্ষণে সিক্ত হচ্ছে মাটি। মায়ের বুকের মেঘ কেটে যায় অবিরত বর্ষণে। ইশ্! সেদিন যদি কেউ সেই মায়ের মুখ দেখত!
এ রকম অসংখ্য ঘটনার মালা গেঁথে তৈরি হয়েছিল ষোলোই ডিসেম্বর। হাসি-কান্নার যুগলবন্দীতে সে এক অনন্য মহাকাব্য! আজকের তরুণ কি স্পর্শ করতে পারবে সেই দিনটিকে? সে কি অনুভব করতে পারবে একটি বিজয়ের পেছনে কতগুলো মানুষের সাদা হাড়ের কঙ্কালের পাহাড় জমে উঠেছিল? কতগুলো বর্ষা এসেছে বসন্তের আগে?
ইশ্! যদি কোনো টাইম মেশিনে করে চলে যাওয়া যেত সেই অমৃত সময়ে! পতপত করে মাথার ওপর উড়তে থাকা বিজয় নিশানের দিকে তাকিয়ে, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে ওঠা যেত ‘জয় বাংলা’ বলে—নাইন মান্থস টু ফ্রিডম তথ্যচিত্রটিতে দেখা সেই মুক্তিযোদ্ধার মতো!
কে বলে আমাদের কোনো মহাকাব্য নেই? একাত্তরের মতো এত বড় পরিসরে কটা জাতি কটা মহাকাব্য লিখেছে? আজকের তরুণের শরীরে যে রক্ত প্রবহমান, তাতে আছে মুক্তিযুদ্ধের বীজ। মাত্র এক-দুই বা তিন প্রজন্ম আগে তাদেরই কোনো পূর্বপুরুষ মুক্তিযুদ্ধের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছিল নৌকা। সেই হিরণ্ময় মানুষদের নিয়ে এই প্রজন্ম কি গর্ব করে?
ইশ্! যদি এক প্রজন্মের সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তৈরি করা যেত মেলবন্ধন! তবেই তো একই স্রোতধারায় মিলে এগিয়ে যেত বাংলার ইতিহাস।
ইশ্! বিজয়ের আনন্দ যদি ধুয়ে দিত সব অনাচার!
আজকের কোনো এক পাঁচ বছরের শিশুকে বলি, তোমরা অনেক সৌভাগ্যবান। জন্মেছো এক স্বাধীন দেশে। আর আমরা, সে সময়ের শিশুরা, আমাদের ছোট ছোট বুকে বহন করেছি স্বাধীনতার পথ ধরে জমে থাকা যত ক্লেদ, যত নৃশংসতা। যত বিস্ময়, যত আনন্দ!
ইশ্! তোমাকে যদি আমাদের সে সময়ের পোশাকটা পরাতে পারতাম!
‘মুক্তি’ আর ‘স্বাধীনতা’—শব্দ দুটো তোমাদের জন্যই তো সৃষ্টি করেছিল তোমাদেরই পূর্বপুরুষেরা।
তোমাদের এই সৌভাগ্যকে ঈর্ষা করতে মন চায়। তারপর তোমাদের প্রতি এক অনাবিল মমত্বে মন ভরে ওঠে। তোমাদের হাসিই তো মুছে দেয় অস্তিত্বের সমস্ত খেদ। একটি স্বাধীন দেশে তোমাদের বেড়ে ওঠা—এই তো বিজয়।
জাহীদ রেজা নূর

No comments

Powered by Blogger.