বৈদেশিক ঋণ-দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা by মহিউদ্দিন আহমদ

মাদের বহিঃসম্পদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা এবং তাঁর একজন বিদেশি কাউন্টারপার্ট চুক্তি সই করছেন এবং পেছনে মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ বিদেশি মেহমান হাসিমুখে দাঁড়িয়ে তা দেখছেন, এই দৃশ্যে আমরা অভ্যস্ত। ঋণ বা খয়রাতি সাহায্যের চুক্তি হলে মিডিয়াকে দাওয়াত দিয়ে তা সাড়ম্বরে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। বিদেশ থেকে সাহায্য আনতে পারার পারঙ্গমতা আমাদের সরকারগুলোর সক্ষমতার নির্ণায়ক হিসেবে এক ধরনের পারসেপশন তৈরি করা হয়েছে।


বিদেশিরা আর সাহায্য দেয় না, এটা যেন একটা অভিশাপ! সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত সাইফুর রহমান একবার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, ‘খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে বিদেশি সাহায্য কমে যাবে।’ তিনি অবশ্য বহিরাগত ও অনুপ্রবেশকারী পাখি আমাদের খেতের ফসল খেয়ে ফেলে এটা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন।
বিদেশ থেকে যে সাহায্য আমরা পাই, তার একটা অংশ অনুদান আরেকটা অংশ ঋণ। ২০০০ সাল পর্যন্ত ঋণ ও অনুদানের অনুপাত প্রায় সমান সমান ছিল। এরপর থেকেই অনুদানের পরিমাণ কমতে থাকে, বেড়ে যায় ঋণের পরিমাণ। বাংলাদেশে গত চার দশকের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ঋণ হয়েছে ২০০৯-১০ অর্থবছরে। ২০০৪-০৫ সাল থেকে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ করছে প্রতিবছর। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
ঋণ হোক আর খয়রাত হোক, যারা দেয়, আমরা তাদের বলি দাতা। তো এই দাতাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এরা ঋণ দিয়েছে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। দ্বিতীয় স্থানে আছে বিশ্বব্যাংক। তারা দিয়েছে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার। দ্বিপক্ষীয় সাহায্যের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও জার্মানি। মুসলিম উম্মাহর দেওয়া সাহায্য নেই বললেই চলে। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক গত বছর দিয়েছিল ২৫ মিলিয়ন ডলারের মতো। ওদের সঙ্গে আমাদেরও নাকি বিশেষ সম্পর্ক।
খয়রাতি সাহায্য এলে তার তেমন দায় নেই। কিন্তু ঋণ করলে শোধ দিতে হয় সুদে-আসলে। বিশ্বব্যাংক এবং এডিবির ঋণ শোধে সাধারণত ১০ বছর রেয়াত পাওয়া যায়। একাদশ বছর থেকে শোধ দিতে হয় কিস্তিতে। কিস্তি চলে ৩০ বছর ধরে। আশির দশকে আমরা যেসব ঋণ নিয়েছিলাম, তা এখনো শোধ করতে হচ্ছে। এর পরিমাণ বাড়ছে প্রতিবছর। ১৯৭৩-৭৪ সালে আমরা দায় পরিশোধ করেছিলাম ১৮ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে অর্ধেক ছিল সুদ, বাকি অর্ধেক আসল। ২০০৯-১০ সালে আমরা সুদ পরিশোধ করেছি ১৯০ মিলিয়ন ডলার, আসল দিয়েছি ৮৭৬ মিলিয়ন ডলার। এটা আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন বরাদ্দের মোট পরিমাণের সমান। মোটা দাগে বলা যায়, আমাদের রাষ্ট্র নাগরিকদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বন্ধক রেখে ঋণ চুক্তি সই করছে। রাষ্ট্র কি এ জন্য জনগণের অনুমতি নেয়? জনমতের তোয়াক্কা করে?
বাংলাদেশের বর্তমান দায়ের (পরিশোধযোগ্য দেনা) পরিমাণ প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলার। টাকার হিসাবে বর্তমান বাজারমূল্যে এর পরিমাণ হলো এক লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আজ যে শিশুটি জন্ম নিল, সে সাড়ে ১০ হাজার টাকা বৈদেশিক ঋণের বোঝা নিয়ে এই পৃথিবীতে এল। আমরা তার জন্য কেমন পৃথিবী রেখে যাচ্ছি?
ঋণের নামে অর্থলগ্নি করা শিল্পোন্নত দেশগুলোর শানশওকতের একটা বড় মাধ্যম। তৃতীয় বিশ্বের সরকারগুলো নিজেদের শানশওকতের জন্য ঋণ করে বেড়ায় আর শিল্পোন্নত দেশগুলো এর সুযোগ নেয়। এক হাতে যা দেয়, অন্য হাতে আদায় করে তার চেয়ে বেশি। ২০০৭ সালে শিল্পোন্নত দেশগুলোর মোট বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ছিল ১০৪ বিলিয়ন ডলার। ওই বছর সুদ ও আসল মিলিয়ে তারা আদায় করেছিল ১৯০ বিলিয়ন ডলার। এক হিসাবে দেখা যায়, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো ১৯৮৫-২০০৭ সালের মধ্যে, অর্থাৎ ২২ বছরে যে পরিমাণ ঋণ করেছিল, শোধ দিতে হয়েছিল তার চেয়েও ৭৬০ বিলিয়ন ডলার বেশি। পৃথিবীতে এমন দেশও আছে, যারা ঋণের সুদ পরিশোধ করার জন্য নতুন করে ঋণ নেয়। এদের অর্থনীতির ঝুড়ি ফুটো হয়ে গেছে। কিন্তু এদের কর্তাব্যক্তিদের শানশওকত ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক সরকারপ্রধানের চালচলন দেখলে শিল্পোন্নত দেশের অনেক সরকারপ্রধানই লজ্জা পাবেন। বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। ১৯৯৭-৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের খরচ ছিল ৪৬ কোটি টাকা। ২০১০-১১ সালে তা বেড়ে গিয়ে হয়েছে ১৮১ কোটি টাকা। একই সময়ে জাতীয় সংসদের খরচ ২৬ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১০৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
আমরা যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ঋণ করি, তা কি খুবই জরুরি? ওই প্রকল্পগুলো না হলে কি আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা থেমে যাবে? অথবা একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়, তাকি যুক্তিসংগত? এখানে আমি একটি উদাহরণ দিতে চাই।
১৯৭৫ সালে পাঁচ লাখ ২৪ হাজার টন বার্ষিক উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আশুগঞ্জে একটি ইউরিয়া সার কারখানা তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। খরচ হিসাব করা হয় প্রায় ২৪২ মিলিয়ন ডলার। ঋণের জোগানদাতা হলো বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও ইউএসএইড। তারপর দেখা গেল, দফায় দফায় এর খরচের অঙ্ক বাড়ছে। ১৯৭৮ সালে এর খরচ প্রাক্কলন করা হলো ৪১০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ২২৬ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রায়। অথচ প্রায় একই সময়ে সৌদি আরব বার্ষিক পাঁচ লাখ ৭০ হাজার টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ইউরিয়া কারখানা করল ২৮৫ মিলিয়ন ডলার খরচে। ফুলপুরে ভারত একই কারখানা করল চার লাখ ৯৫ হাজার টন উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে ১৮৬ মিলিয়ন ডলারে, মিরপুর মাথেলোতে বার্ষিক পাঁচ লাখ ৭০ হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন কারখানা বানালো পাকিস্তান ১৭৮ মিলিয়ন ডলার খরচ করে। আমার অনুমান ওই সময়ে, অর্থাৎ ১৯৭৮-৮০ সালে আশুগঞ্জ ইউরিয়া সার কারখানা বানাতে ‘কমিশন বাণিজ্য’ হয়েছে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের। অর্থাৎ প্রকৃত খরচ যা হয়েছে, লুটপাট হয়েছে তার চেয়ে বেশি। ১৯৭৮-৮০ সালে যারা বাংলাদেশের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের এ ব্যাপারে জবাবদিহি করা দরকার। এখন কে দেবে এই জবাব? আমরা তো এখনো এই কারখানার জন্য ঋণ করা অর্থের দায় মিটিয়ে যাচ্ছি!
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বর্তমানে আমাদের জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) দুই শতাংশেরও কম হচ্ছে বার্ষিক বৈদেশিক ঋণ। অর্থাৎ খরচের ৯৮ শতাংশেরও বেশি জোগান দিচ্ছেন আমাদের নাগরিকেরা। চুরি ও অপচয় কমাতে পারলে বৈদেশিক সাহায্য ছাড়াই আমরা উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নটুকু করতে পারি। টিআইবি একটা হিসাব দিয়েছিল, দুর্নীতি সহায়ক মাত্রায় নামিয়ে আনতে পারলে আমরা বছরে দুটো যমুনা সেতুর মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারি। আমাদের তো বিদেশের কাছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বন্ধক রেখে হাত পাতার দরকার নেই।
তারপরও আমাদের রাষ্ট্রীয় অভিভাবকেরা হন্যে হয়ে ‘দাতা’ খুঁজে বেড়ান, মেগা প্রজেক্ট তৈরি করেন একের পর এক। কারণ, প্রজেক্ট মানেই কমিশন। এই কমিশন খেয়ে খেয়ে গুটিকয়েক পরিবার ফুলে-ফেঁপে উঠছে আর দেনার দায়ে আমাদের মাথাগুলো বাঁধা পড়ছে গ্লোবাল ফাইন্যান্সের জাঁতাকলে। ঋণ বাড়ছে, দায় বাড়ছে। আমরা ক্ষতিকর, অপ্রয়োজনীয় ও অনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়নের এক দুষ্টচক্রে আটকা পড়ে গেছি।
 মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।

No comments

Powered by Blogger.