চার মাসের মমতা সরকার by সুব্রত আচার্য্য

মতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার চার মাস অতিক্রম করল গত ২০ অক্টোবর। এই বয়সের একটি সরকারের ভালো-মন্দ বিশ্লেষণ করার কাজটা খুব কঠিন। প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ কেমন সম্পর্ক গড়ে তুলবে। কিংবা কেমন হবে প্রতিবেশী দেশ, বিশেষ করে একই ভাষার দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক। পুরোপুরি দৃশ্যমান না হলেও তৃণমূল সরকারের ১২২ দিনে কিছুটা আঁচ অন্তত এরই মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে।


প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক হবে; এই প্রশ্ন দিয়ে যদি শুরু করা হয়, তাহলে প্রশ্নের উত্তরটি কিন্তু হবে বেশ জটিল। যদি এর পরও প্রশ্ন ওঠে_কেন জটিল? বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভালো সম্পর্ক। ইলিশ মাছ থেকে ঢাকাই জামদানি শাড়ি; নির্বাচনের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর কয়েক দফায় বাংলাদেশের মানুষের শুভেচ্ছাসহ মমতার কাছে বার্তা পাঠিয়েছেন শেখ হাসিনা। পক্ষান্তরে চলতি অর্থবছরে রেল বাজেট পেশ করার সময় লোকসভায় দাঁড়িয়ে কলকাতা-ঢাকার মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করতে 'সাংস্কৃতিক এঙ্প্রেস' চালু ছাড়াও বিশেষ একটি ট্রেন চলাচলের ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী তথা বর্তমানের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শেখ হাসিনার অনুরোধে সেই ট্রেনের নামও চূড়ান্ত করেছিলেন মমতা_'সোনার তরী'। শুধু সৌজন্য নয়, বরং এর চেয়েও কয়েক ধাপ এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচনের তৃণমূলের চূড়ান্ত জয়ের খবর আসার আগে দুপুর ১২টায় সব প্রটোকল ভেঙে, একজন বড় বোন হিসেবে শেখ হাসিনা ছোট বোন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, মমতার শপথের দিনও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। সম্ভবত ৩৪ বছরের বামফ্রন্টের শাসনের একঘেয়েমির খবর বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও এক ধরনের পরিবর্তনের বাসনা তৈরি করে দিয়েছিল। আর সে কারণে নির্বাচনের আগে থেকে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি দেখা যায় সরল সমর্থন। এবার আসা যাক, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমতায় বসার পর দৃশ্যটা কেমন ছিল এই চার মাস সময়ের মধ্যে, সে কথায়। মে মাসের ২০ তারিখ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মমতা। জুন-জুলাই-আগস্ট মমতা মহাব্যস্ত ছিলেন। বিগত বামফ্রন্ট সরকারের রেখে যাওয়া নানা সমস্যা, বিশেষ করে স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে মুখ্যমন্ত্রীর কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছিল। এর মধ্যেই নির্ঘণ্ট হয় ৫ এবং ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সফরসঙ্গী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাওয়ার সম্ভাবনার খবর ছড়িয়ে পড়ে। এই সম্ভাবনা আরো প্রকট হয় আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়। তখন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আগস্টের শেষ দিকে মমতা ঢাকা যাওয়ার সম্মতি প্রকাশ করেন। আর তখনই যেন দুই দেশের কূটনৈতিক মহলে ব্যাপক তৎপরতা শুরু হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. সিংয়ের ঢাকা সফরকালে বেশ কয়েকটি চুক্তি হওয়ার কথা বলা হয়। এর মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি অন্যতম। যেহেতু তিস্তা নদী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ওপর দিয়ে প্রবাহিত, তাই রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হচ্ছেন, এতে বাড়তি গুরুত্ব উপলব্ধ হয় সব মহলে। ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন তিস্তা চুক্তির খসড়া নিয়ে দেখা করেন মমতার সঙ্গে। সেই খসড়ায় স্বাক্ষরও করেন রাজ্যটির প্রশাসনিক প্রধান তথা প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী মমতা। এর পরই বহু প্রতীক্ষিত তিস্তা চুক্তি হচ্ছে ধরে নেয় ঢাকা-দিলি্লর কূটনৈতিক মহল। কিন্তু রণে ভঙ্গ দেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা। প্রায় হঠাৎ ৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হচ্ছেন না বলে কলকাতার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সাংবাদিককে জানান মমতা। যদিও কোনো সংবাদমাধ্যমই সরাসরি এ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কোট করে এই খবরটি প্রকাশ করেননি। এর পরই শুরু হয় চরম কৌতূহল। পর দিন শোনা যায় তিস্তা চুক্তি নিয়ে মমতা আপত্তি তুলেছেন। ১৯ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লালমনিরহাটের পাটগ্রামের তিনবিঘা করিডর পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তিনবিঘা করিডর পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার অন্তর্গত। স্বাভাবিকভাবে কূটনৈতিক মহল আশা করেছিল, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেখানে যাবেন। আর সেখানেই হাসিনা-মমতা নিজেদের মধ্যে কথা বলবেন পারস্পরিক বিষয়ে। আলোচনায় আসতে পারে তিস্তা ইস্যুটি। কিন্তু সেখানেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যাননি। এমন কি পশ্চিমবঙ্গের তরফ থেকে কোনো মন্ত্রীকেও পাঠানো হয়নি। এই অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে, বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়াই এই প্রশ্ন তোলে বলা যায়। যদিও মিডিয়াগুলো এও জানায়, এখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দোষ নেই। কারণ এটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা কেন্দ্রীয় সরকারের অনুষ্ঠান ছিল। আমন্ত্রণ না জানালে প্রটোকল অনুযায়ী মুখ্যমন্ত্রী সেখানে যেতে পারেন না। ১৮ তারিখ নিয়মমাফিক কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে এক বার্তা পাঠানো হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে। যেখানে শুধু তিনবিঘার অনুষ্ঠান সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। মহাকরণ সূত্রের বরাদ দিয়ে ১৯ তারিখে এই খবর প্রকাশ হয় আনন্দবাজার পত্রিকায়। কিন্তু যতই কেন্দ্রীয় সরকারের অনুষ্ঠান হোক না কেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ে যদি চাইতেন তাহলে নিশ্চিত, এ ব্যাপারে একটা আলোচনার রাস্তা তৈরির ক্ষেত্র করে দেওয়ার সুযোগ ছিল বলেও মনে করছেন অনেকে। তাঁদের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার কথা বরাবর মমতা বলে আসছেন; তবে কেন তিস্তা ইস্যুতে নিজের অবস্থান এখনো পরিষ্কার করেননি ওই নেত্রী? কেন এখনো এ নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেননি? কিংবা ব্যক্তিগতভাবেও তো সমস্যা সমাধানে টেলিফোনে কথা হতে পারত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে? এসব কিছুই হয়নি। গত চার মাসে ভালো কাজ যে হয়নি, সেটা একদমই বলা যাবে না। খোদ বিরোধী বামফ্রন্টও সেটা বলছে না। জঙ্গলমহলে মাওবাদী সমস্যা মেটাতে উন্নয়নকে হাতিয়ার করছেন মমতা। একইভাবে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দীর্ঘ এক দশক ধরে উত্তপ্ত পার্বত্য অঞ্চলকেও শান্ত করে দিয়েছে মমতার নতুন সরকার। এ ছাড়া জেলায় জেলায় ঘুরে একেবারে পাড়ার রাস্তাঘাট থেকে মহাসড়ক উন্নয়নে নতুন ধারাপাত খুলতে শুরু করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সরকার তো উন্নয়ন করবেই। জনগণ এ কারণেই তো ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে তাদের। কিন্তু সেই সরকার যদি পূর্বতন সরকারের পথে হাঁটতে শুরু করে, চার মাসের আমরা (তৃণমূল) কিংবা ওরা (বামফ্রন্ট বা বিরোধী দলগুলো); এমন বিভাজনের ইঙ্গিত দিতে শুরু করে_ তখনই প্রশ্ন ওঠে। আশঙ্কা তৈরি হয়, সরকারের বাকি দিনগুলোতে কী হবে? এখনো তৃণমূল সরকারের হাতে রয়েছে এক হাজার ৮২৫ দিন। এর মধ্যে মাত্র ১২২ দিন অতিক্রম করেছে। বাকি দিনগুলোতে আরো অনেক কিছুই দেখতে হবে। ভালো কিংবা মন্দ। এই কয়দিনে সরকারের কর্মকাণ্ড থেকে এই নির্যাসটা নিতে গিয়ে কিন্তু গরম একটা ঝাঁজই পাওয়া যাচ্ছে।
লেখক : কলকাতার সাংবাদিক
subrata.acharjee@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.