নতুন নামে পরিচয় by একরামুল হক শামীম

রিবারের সবাই চেয়েছিলেন সন্তানটি ছেলে হবে। সেই অনুযায়ী নামও ঠিক করে রেখেছিলেন নবজাতকের দাদা। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা হয়তো এই নাম ঠিক করা নিয়ে মজাই পেয়েছিলেন। সন্তান হলো মেয়ে। কন্যাসন্তান দেখে দাদার রাগ হলো খুব। শুরুতে নবজাতকের মুখই দেখতে চাইলেন না। কন্যাসন্তান তার পরিবারের কাছে অবাঞ্ছিত। নাম রাখা নিয়েও সংকট তৈরি হলো। একটা নাম তো অন্তত রাখতে হবে। দাদা নাম রাখলেন 'নাকুশা', বাংলায় যার মানে অবাঞ্ছিত।


অবাঞ্ছিত হয়েই বেড়ে উঠতে হলো মেয়েটিকে। পরিবারের সদস্যরা তাকে ঠিকভাবে যত্ন করে না, খেলার সাথীরা তাকে খেলায় নেয় না, এমনকি স্কুলের সহপাঠীরাও তাকে নিয়ে নানা ধরনের বিদ্রূপ করে। মেয়েটি একা একা বসে ভাবে। ভেবে পায় না কী তার দোষ। কেনই-বা তাকে জীবনের সবক্ষেত্রে অবহেলার শিকার হতে হচ্ছে। মেয়েটি ভাবে কেবল। মায়ের কাছে জানতে পারে কীভাবে সে পরিবারের অবাঞ্ছিত সন্তান। কারণ, পরিবারের সবাই যে ছেলেসন্তানের প্রত্যাশা করেছিল। ছেলেসন্তানের পরিবর্তে কন্যাসন্তান হওয়া সেই পরিবারের কাছে উপদ্রব হিসেবেই হাজির! বছরের পর বছর সেই দায় বয়ে বেড়াতে হয়েছে মেয়েটিকে। মেয়েটির বয়স এখন ১৫, স্থানীয় একটি স্কুলে পড়ালেখা করে। ১৫ বছরের এই জীবনে প্রথমবারের মতো বড় ধরনের আনন্দের উৎসব তার সামনে হাজির হয়েছে সম্প্রতি। রাজ্য সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তার নাম পরিবর্তনের সুযোগ দিয়েছে। নতুন নাম নিয়ে তার চিন্তাভাবনার সীমা ছিল না। কী হতে পারে নতুন নাম, কতটা আকর্ষণীয় হবে সেই নাম এই ভাবনাতেই কয়েকদিন গেছে। অবশেষে সে নাম বাছাই করেছে 'অস্মিতা'। নামটি শুনতে চমৎকার, ভেবে আনন্দিত মেয়েটি। এখন থেকে সে অস্মিতা নামেই পরিচিত হবে। শ্রেণীকক্ষের বন্ধুরা আর তাকে অবাঞ্ছিত বলে ডাকবে না।
সম্প্রতি (২২ অক্টোবর) ভারতের মহারাষ্ট্রে নামবদলের উৎসব হয়ে গেল। সেখানে প্রায় ২৮৫ জন ভারতীয় মেয়ে তাদের পুরনো নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রেখেছে। নতুন নাম রাখার মাধ্যমে তারা নতুন জীবনের শুরু করতে যাচ্ছে। ২৮৫ জন মেয়ের পুরনো নামগুলো ছিল বৈষম্যমূলক। হয়তো তাদের জন্মে পরিবারের কোনো সদস্য খুশি হননি আর এমনিতেই একটা বৈষম্যমূলক নাম রেখে দেওয়া হলো। সেই নামের দায় তাদের বয়ে বেড়াতে হয়েছে এতদিন। নাম পরিবর্তন উৎসবে তাই তাদের দেখা গেছে আনন্দিত অবস্থায়। প্রত্যেকেই তাদের সেরা পোশাকটি পরেছে, কেউ কেউ চুলে গুঁজে দিয়েছে ফুল, কেউ নিজের ইচ্ছামতো চুলে বেণি করে হাজির রয়েছে। সবার হাতে ছিল নামসহ একটি সার্টিফিকেট। মহারাষ্ট্র রাজ্যের সাতারা জেলায় এই নাম পরিবর্তনের উৎসব হয়। নাম পরিবর্তনের সুযোগ পেয়ে তারা নিয়েছে পছন্দমতো নাম। কেউ হয়েছে বলিউডের নায়িকা, কেউবা আবার পৌরাণিক কোনো চরিত্র। ২৮৫ জনের মধ্যে একজন নাম নিয়েছে ঐশ্বরিয়া, আরেকজনের নতুন নাম সাবিত্রী। বৈশালী নামটিও নিয়েছে একজন, যার মানে সুন্দর। এভাবেই পুরনো বৈষম্যমূলক নামের গন্ধ মুছে ফেলতে চাচ্ছে সেই ২৮৫ জন মেয়ে, যেমন করে জীবনানন্দের কবিতায় 'ডানায় রোদের গন্ধ মুছে পেলে চিল'।
ভারতের মেয়েদের বৈষম্যমূলক নাম পরিবর্তনের সংবাদটি পড়ে বাংলাদেশের মেয়েদের নামের কথা ভাবতে হলো। অস্মিতার (নতুন নাম) পরিবারের মতো পরিবার বাংলাদেশেও রয়েছে। পরিবারের সদস্যরা চাচ্ছেন ছেলেসন্তান, তখন কন্যাসন্তান হলেই নাম ঠিকমতো রাখা হয় না। নামের ক্ষেত্রে এই অবহেলার দায় মেয়েটিকে বয়ে বেড়াতে হয় তার পরবর্তী জীবনে। মেয়ের নাম রাখার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি কী ভেবে দেখবেন আমাদের অভিভাবকরা?
 

No comments

Powered by Blogger.