মাতৃভাষা-বাংলা ব্যাকরণ by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

জ আমাদের এক বড় দিন। আমাদের দেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তিতে এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীতে বাংলা ভাষার ৩৩ জন পণ্ডিত আমাদের জন্য প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা করে আমাদের করেছেন ‘সম্মানিত ও সহায়বান’।


শেষোক্ত শব্দ দুটি রবীন্দ্রনাথ বড় আশা করে ১৩০৮ সালে উচ্চারণ করেছিলেন। বাঙালির দ্বৈধ ও দ্বিমত প্রবণতা সত্ত্বেও যে ব্যাকরণসমবায় রচিত ও প্রকাশিত হলো তাতে আমরা গর্বিত ও পুলকিত।
লাতিন ভাষার রবরবা সম্পর্কে বলতে গিয়ে Charlton Laird তাঁর The Meaning of Language (১৯৫৩) গ্রন্থে বলেন, ‘বেশ স্বাভাবিকভাবেই পণ্ডিতেরা ধরে নেন যে লাতিন ব্যাকরণ শুধু লাতিন ব্যাকরণই নয়, এ স্বয়ং ব্যাকরণ। তাঁরা এর থেকে ঋণ করেন এবং তার বেশ সদ্ব্যবহার করেন।’ এমন ধারণা ভারতবর্ষে সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে বিদ্যমান ছিল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সেই বেলুনে প্রথম খোঁচা দিয়ে বলেন, ‘সংস্কৃত হলো বাংলার অতি-অতি-অতি-অতি-অতি-অতিবৃদ্ধ প্রমাতামহী।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভাষার ইঙ্গিত’ প্রবন্ধে বলেন, ‘সংস্কৃত ভাষার যোগ ব্যতীত বাংলার ভদ্রতা রক্ষা হয় না এবং বাংলা তাহার অনেক শোভা ও সফলতা হইতে বঞ্চিত হয়, কিন্তু তবু সংস্কৃত বাংলার অঙ্গ নহে, তাহা তাহার আবরণ, তাহাতে লজ্জা রক্ষা, তাহার দৈন্য গোপন, তাহার বিশেষ বিশেষ প্রয়োজন সাধনের উপায়।’ ১৩০৮ সালে বাংলা ব্যাকরণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে ‘বাংলা ব্যাকরণ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বস্তুত প্রত্যেক ভাষার নিজের একটা ছাঁচ আছে, ...... ভাষার সেই প্রকৃতিগত ছাঁচটা বাহির করাই ব্যাকরণের কাজ। সংস্কৃত ও অন্য ভাষার আমদানিকে কী ছাঁচে ঢালিয়া আপনার করিয়া লয়, তাহাই নির্ণয় করিবার জন্য বাংলা ব্যাকরণ।’
উপরোল্লিখিত গ্রন্থ The Meaning of Language-এ Charlton Laird বলেন, ‘ব্যাকরণ একপ্রস্থ নিয়ম-বিধি নয়, এ এমন এক জিনিস যা ভাষার মধ্যেই নিহিত রয়েছে এবং এ ছাড়া ভাষার অস্তিত্ব নেই। এ আবিষ্কার করা যায়, কিন্তু উদ্ভাবন করা যায় না।’
আমাদের ভাষার অভিধান-ব্যাকরণের আবিষ্কার বিদেশিদের হাতে। প্রকাশিত গ্রন্থটি যাঁদের নামে উর‌্যাসর্গ করা হয়েছে তাঁরা মানুয়েল দা আসসুম্পসাঁও থেকে ব্রাদার জেমস পর্যন্ত ১৩ জন। আমি ই এস বিকোভার রুশ ভাষায় রচিত এবং হানা রুথ টমসনের ইংরেজি ভাষায় রচিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ চোখে দেখিনি। ভাগ্যবান পাঠকগণ যাঁদের ওই গ্রন্থদ্বয়ের সঙ্গে পরিচয় রয়েছে তাঁরা আমাদের ব্যাকরণটির তুলনামূলক আলোচনা করার সুযোগ পাবেন।
ভাষাতত্ত্ব ও ব্যাকরণ একই সীমানাবিশিষ্ট (Coterminous) নয়। দুই শাস্ত্রের মধ্যে চলাচল থাকলেও তাদের চৌহদ্দি হুবহু এক নয়। বিশেষ করে একটি বিশেষ ভাষার ব্যাকরণ তো নয়ই। এ জন্য আমার মনে হয় ভাষাতত্ত্বের ওপর কিছু আলোচনা বিশেষ করে ব্যাকরণের দ্বিতীয় ভাগের ক্ষেত্রে আমার কাছে প্রক্ষিপ্ত মনে হয়েছে। এই ব্যাকরণটি দুই খণ্ডে না হয়ে এক খণ্ডে সম্পন্ন হলে অনেক ব্যবহার-সহায়ক হতো। আমার অবস্থা এখন সেই নরসুন্দরের মতো, যিনি নরুণ দিয়ে ফোঁড়া কাটতে পারতেন। তিনি শৈল্য চিকির‌্যাসাবিদ্যা অধ্যয়নের পর ফোঁড়া দেখলে থরহরি কম্পমান হন। আমাদের জন্য একজন রাজশেখর বসু এবং একটা চলন্তিকা ব্যাকরণ একান্ত প্রয়োজন। ‘বাংলা ব্যাকরণ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘অভিধান-ব্যাকরণ অর্থের লোহার সিন্দুক— তাহারা অর্থ দিতে পারে না, বহন করিতে পারে। চাবি লাগাইয়া সেই অর্থ লইতে হয়।’ আর আমি বলি, সেই চাবি পেতে আমাদের বাংলা ভাষার রেওয়াজ করতে হবে।
ভাষাতত্ত্বের আদলে ব্যাকরণের যেসব দুরূহ পারিভাষিক ব্যবহার করা হয়েছে তার পক্ষে রবীন্দ্রনাথকে আমি সাক্ষ্য মানি। কবি তাঁর বিশ্বপরিচয় গ্রন্থে বলেন, ‘পারিভাষিক চর্ব্য জগতের জিনিস, দাঁত ওঠার পথে যেটা পথ্য।’ এ কথা বলা হলেও তিনি বলেন, ‘ভোজনের যেমন আনন্দ আছে তেমনি তার মূল্যও আছে, ছেলেবেলা থেকে মূল্য ফাঁকি দেওয়া অভ্যাস হতে থাকলে যথার্থ আনন্দের অধিকারকে ফাঁকি দেওয়া হয়। চিবিয়ে খাওয়াতেই একদিকে দাঁত শক্ত হয় আর একদিকে খাওয়ার পুরো স্বাদ পাওয়া যায়।’ পারিভাষিক নির্মিত শব্দগুলো বাংলা বলে পরিচয় নিবিড় হতে আমাদের তেমন সময় লাগার কথা নয়। এ ব্যাকরণ পড়তে আমার যত কষ্টই হোক না কেন, আমার কোনো রকম বিরক্তিসূচক কোনো দন্ত্যসশীর‌্যাকার ধ্বনি উচ্চারণ করার অধিকার নেই। আমি সজোরে একটা ওষ্ঠ্যশীর‌্যাকার ধ্বনি উচ্চারণ করে একে চুম্বন করে আমার বক্তব্য শেষ করছি। আপনাদের জয় হোক।
[৭ জানুয়ারি বাংলা একাডেমীর বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে দেওয়া প্রধান অথিতির বক্তব্য।]
 মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা। সাবেক প্রধান বিচারপতি।

No comments

Powered by Blogger.