এক নতুন বাংলাদেশের অঙ্গীকার-বিজয়ের ৪০ বছর

স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হয়েছিল যে প্রাণপণ যুদ্ধ, ১৬ ডিসেম্বর আমাদের চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে তার অবসান ঘটে। আজ সেই দিন: আমাদের মহান বিজয় দিবস। স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বিজয়ের ৪০ বছর পেরিয়ে এল। এই দিনে শহীদদের রক্তে রাঙা সূর্যের দিকে চেয়ে আমরা বলি: আমরা তোমাদের ভুলব না।


যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, যাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা জুগিয়েছিলেন, তাঁদের সবার প্রতি রইল বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আবির্ভাব ছিল যুগান্তকারী এক ঘটনা। তা ঘটতে পেরেছে সাড়ে সাত কোটি মানুষের দৃঢ়প্রত্যয়, অশেষ ত্যাগ-তিতিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের সময়োপযোগী বুদ্ধিদীপ্ত ভূমিকা এবং ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের জোরালো সহযোগিতার কারণে। এই দুই দেশের তৎকালীন নেতৃত্ব ও জনসাধারণের প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। এ ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের যেসব রাজনীতিক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন, আমাদের পক্ষে বিশ্বজনমত সংগঠনে সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁদের প্রতিও আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
লাখো প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীন দেশটি আমরা অর্জন করেছি আজ থেকে ৪০ বছর আগে, তা নিয়ে আমাদের স্বপ্ন ছিল অনেক। দেশের জন্য যাঁরা প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, যাঁরা যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন, যাঁরা তাঁদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন এবং যে বিপুল জনগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস নৃশংস হানাদারকবলিত স্বদেশে আতঙ্কে দিনাতিপাত করেছেন—সবারই স্বপ্ন ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ হবে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক, মানবিক, শান্তিময় ও সমৃদ্ধ একটি দেশ। চার দশক পর আমরা যখন আরেকটি বিজয় দিবস উদ্যাপন করছি, তখন সেই স্বপ্ন ও অঙ্গীকারের কথা বিস্মৃত হয়ে থাকা যায় না। আমাদের হিসাব মেলানো প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন আমরা কতটা পূরণ করতে পেরেছি।
গত চার দশকে দেশের দারিদ্র্য-পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার বিস্তার ঘটেছে, উৎপাদনের ভিত্তি কিছুটা জোরালো হয়েছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে। কিন্তু রাজনীতি ও প্রশাসনের সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি, যথেষ্ট মজবুত হয়নি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো, মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে, দুর্নীতি কমেনি। কিন্তু একই সঙ্গে এ-ও সত্য যে, জনসাধারণের গণতান্ত্রিক চেতনা বেড়েছে; প্রসারিত হয়েছে অধিকার সচেতনতা। দৃঢ়তর হয়েছে শাসনব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির দাবি। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি হয়েছে আগের চেয়ে অনেক জোরালো। তাই গত চার দশক যেভাবে চলেছে, তা আর চলতে পারে না। বিজয় দিবস এক মহান উপলক্ষ, যখন আমরা মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা, স্বপ্ন ও অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করতে পারি। নতুন করে শপথ নিতে পারি স্বপ্নের সেই বাংলাদেশ গড়ার।
একাত্তরের গণহত্যাসহ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের দাবিতে প্রবল জনমত ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষাই তুলে ধরে। মানবতার বিরুদ্ধে শতাব্দীর নৃশংসতম অপরাধগুলোর বিচারের মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার চার দশকের দায় মেটানোর তাগিদ আজ আরও বড় হয়ে উঠেছে।

No comments

Powered by Blogger.