এ সপ্তাহের সাক্ষাৎকার-‘মাঝেমধ্যে বোঝাই যায় না এ বাজারের নিয়ন্ত্রক কে’

দেশের শেয়ারবাজারে আবারও বিরাট অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক বাকী খলীলী প্রথম আলো: শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা কেমন করে তৈরি হলো? বাকী খলীলী: বর্তমান অবস্থা বুঝতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে। ২০১০ সালের শেষ দিকে বাজারে বড় ধরনের পতন হতে থাকে। কারণ, বাজার তখন প্রকৃতপক্ষেই অতিমূল্যায়িত ছিল।


এ পরিস্থিতি তৈরির জন্য সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি), বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সবারই দায় রয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সুশাসনের অভাবও এ জন্য দায়ী। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতা হলো, তাদের নীতিকাঠামোর মধ্যেই শেয়ারবাজার ছিল না। আমানতের সুদের হার যখন কম থাকে, তখন মানুষ শেয়ারবাজারে বেশি যায়। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে এক-দেড় বছর আগে আমানতের সুদের প্রকৃত হার নেতিবাচক ছিল। তত্ত্বেও আছে, বাস্তবেও দেখা যায়, এমন পরিস্থিতিতে বন্ড ও শেয়ারবাজারের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ে। আমাদেরও তা-ই হলো। ক্ষতি যেটা হলো, ধীরে ধীরে ফুলে ওঠা গোটা বাজারই হয়ে উঠল ঋণতাড়িত (ক্রেডিট ড্রাইভেন)। বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি বিবেচনায় নেয়নি। পাশ কাটিয়ে যায় এসইসিও। দুটি সংস্থারই সমন্বিত দায় রয়েছে এতে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে নীতিনির্ধারকদের অসতর্কতা ও অবহেলার কারণেই বাজারের এই পরিস্থিতি।
প্রথম আলো: নানা পদক্ষেপের ফলে বাজার স্বাভাবিকতার দিকে যাচ্ছিল, হঠাৎ আবার পতনের ধারা কেন?
বাকী খলীলী: মূল সংকট আসলে আস্থার। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা যেমন কমে গেছে, তা হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদেরও। আর এক বছরে বাজারে এতটাই পতন হয়েছে যে আস্থা নষ্ট হওয়ারই কথা। সার্বিক আস্থা ফেরাতে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে প্রতিষ্ঠানগুলো। তারাই মূলত ‘মার্কেট মেকার’। এখনো বাজারে তাদের অংশগ্রহণ কম। তারা হয়তো মনে করছে যে জনগণের টাকায় বেশি ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। উদ্যোক্তা শেয়ারধারীদের প্রতি শেয়ার কেনার বাধ্যবাধকতা আরোপ আপাতত ইতিবাচক হলেও বোঝা দরকার যে তাঁরা বেশি দামে শেয়ার কিনতে চাইবেন না। অপেক্ষা করবেন কখন দাম কমে। আবার, যখনই বাজার কিছুটা উঠছিল, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা তখন বিক্রির চাপ বাড়িয়ে দিলেন। বাজারের পতন তখন অনিবার্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। হয়েছেও তা-ই।
প্রথম আলো: শেয়ারবাজারে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগসংক্রান্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পুনঃপ্রজ্ঞাপন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাজারে লেনদেন করতে না পারার প্রজ্ঞাপন জারি ও প্রত্যাহার— এসব বিষয়ে কী বলবেন?
বাকী খলীলী: এতে আস্থার সংকট আরও ঘনীভূত হলো এবং বাজারকে আরও অস্থির করা হলো। সরকারি কর্মকর্তারা দৈনন্দিন লেনদেনে অংশ নিতে পারবেন না, আমি নিজেও এই যুক্তি সমর্থন করি। এ জন্য মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে কেন? সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কি এটা? মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্তের আগে এসইসির মতামত নেওয়া দরকার ছিল। সরকারকে এমন বুদ্ধি কে দিল যে এসইসিকে এড়িয়ে বিষয়টি একেবারে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করতে হবে!
অন্যদিকে, দুই স্টক এক্সচেঞ্জের মধ্যেও কোনো সমন্বয় নেই, যে কারণে দুই ভিন্ন সময়ে সেদিন লেনদেন বন্ধ হয়। এ সিদ্ধান্তও ছিল আরেক ভুল। ১৯২৯ সালে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ সাত দিন বন্ধ রেখে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। সেদিন তো এ রকম কিছু হয়নি। তাহলে বন্ধ রাখা কেন?
প্রথম আলো: বাজারের জন্য এখন করণীয় কী?
বাকী খলীলী: এখন দরকার একটি স্থিতিশীল পরিস্থিতি। মাঝেমধ্যে বোঝাই যায় না এ বাজারের নিয়ন্ত্রক কে। অর্থ মন্ত্রণালয়, না এসইসি? শেয়ারবাজার নিয়ে কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনাও ঠিক নয়। আসলে এখন একটাই পথ খোলা আছে; আর তা হলো প্রকৃত সংস্কার এবং এসইসিকে আরও শক্তিশালী করা ও নিজের মতো চলতে দেওয়া। তারল্যও কোনো সমাধান নয়। এখন যদি ১০০ টাকার বিপরীতে ২০০ টাকা ঋণ দেওয়া হয়, কোনো লাভ হবে না। কাজেই পুঁজিবাজারকে শুধু ঋণতাড়িত বাজারে পরিণত করা যাবে না। মূল্য অনুপাতে আয়ের (পিই) সম্পর্ক থাকতে হবে সব সময়। বাজারের স্বার্থে এসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি গ্রহণের মধ্যে নিবিড় সমন্বয় থাকাটাও খুব জরুরি।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফখরুল ইসলাম

No comments

Powered by Blogger.