চিকির‌্যাসায় অবহেলা-প্রধানমন্ত্রীর সতর্কবাণী কাজে দেবে তো? by কুদরাত-ই-খুদা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৭ জানুয়ারি দায়িত্বে অবহেলাকারী চিকির‌্যাসকদের আবারও সতর্ক করে বলেছেন, এ ধরনের অপরাধের জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শুধু তা-ই নয়, প্রধানমন্ত্রী জনগণকে সেবা দিতে সব চিকির‌্যাসকে তাঁদের কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে হবে বলেও নির্দেশ দিয়েছেন।


এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর এ সতর্কবাণীতে চিকির‌্যাসকেরা শেষ পর্যন্ত সতর্ক হবেন কি না এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশমতো দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করবেন কি না? দেশের জনগণের চিকির‌্যাসাসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চিকির‌্যাসকদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী ইতিপূর্বেও অনেকবার নির্দেশ দিয়েছেন, সতর্ক করেছেন। কিন্তু ফলাফল শেষ পর্যন্ত শূন্যের কোটাতেই দাঁড়াতে দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রী চিকির‌্যাসকদের সর্বশেষ যেভাবে সতর্ক করলেন, শেষ পর্যন্ত তার বাস্তবায়ন ঘটে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়। অন্যথায় ডাক্তাররা যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ এবং সতর্কবাণী উপেক্ষা করেও বহাল তবিয়তে থাকতে ‘দক্ষ’ এবং এ জন্য যে শেষ পর্যন্ত তাঁদের কিছুই হয় না, সেই বিষয়গুলোর আবারও প্রতিফলন ঘটবে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে চিকির‌্যাসা অন্যতম প্রধান। আর এ চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে জনগণকে কম হয়রানির শিকার হতে হয় না। বিশেষ করে জনগণ যদি যায় কোনো সরকারি হাসপাতালে। এ দেশে চিকির‌্যাসার ক্ষেত্রে অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি আজ আর কোনো নতুন বিষয় নয়। সরকারি হাসপাতালের অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, দূর-দূরান্ত থেকে আসা সহজ-সরল রোগীদের প্রতারণার শিকার হওয়া, চিকির‌্যাসা সরঞ্জমাদি ও ওষুধপত্রের অভাব, চিকির‌্যাসক-সংকট, সময়মতো হাসপাতালে চিকির‌্যাসকদের উপস্থিত না হওয়া, অধিক অর্থের লোভে সরকারি হাসপাতালের চেয়ে চিকির‌্যাসকদের প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখতে ব্যস্ত থাকা, ক্লিনিকের রোগীদের প্রতি চিকির‌্যাসকদের অধিক যত্নবান হওয়া, সরকারি হাসপাতালে রোগীর সেবার ক্ষেত্রে চিকির‌্যাসকদের অবহেলা, আন্তরিকতার অভাব, ভুল চিকির‌্যাসা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। আর এসব সংবাদের মধ্যে চিকির‌্যাসকদের অবহেলার কারণে বা ভুল চিকির‌্যাসার কারণে রোগীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বা মৃত্যুর ঘটনা ঘটা সবচেয়ে ভয়াবহ ও দুঃখজনক।
চিকির‌্যাসকের অবহেলার কারণে রোগীর মৃত্যু ঘটলে বা আঘাত পেলে তার জন্য আইনে শাস্তির বিধান রয়েছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, চিকির‌্যাসকের অবহেলার কারণে রোগীর মৃত্যু ঘটা বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ক্ষেত্রে এ দেশে আইনের তেমন একটা প্রসার ঘটেনি। তা ছাড়া চিকির‌্যাসার ক্ষেত্রে চিকির‌্যাসকদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিও খুব কম। ফলে চিকির‌্যাসকের গুরুতর অবহেলার কারণে অনেক সময় রোগীর মৃত্যু ঘটলেও চিকির‌্যাসকেরা খুব সহজেই পার পেয়ে যান। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০৪(ক) ধারায় উল্লেখ আছে, কোনো ব্যক্তির অবহেলাজনিত কারণে যদি কারও মৃত্যু ঘটে তবে ওই ব্যক্তিকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা অথবা দুটোই একসঙ্গে শাস্তি হিসেবে দেওয়া যাবে। চিকির‌্যাসকের অবহেলার জন্য দণ্ডবিধির আওতায় এবং টর্ট (দেওয়ানি প্রতিকার) আইনের আওতায় মামলা করা যায়। তবে এ ব্যাপারে দেশের অধিকাংশ জনগণই সচেতন নন। অবহেলার সরাসরি প্রমাণ রয়েছে, এমন ক্ষেত্রেও চিকির‌্যাসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যদি না ক্ষতিগ্রস্ত রোগী বা রোগীর অভিভাবক আইনগত ব্যবস্থা নিতে না চান। প্রথম থেকেই তাঁদের ধারণা জন্মে যে, এ জন্য কিছুই হবে না। আর এ বিষয়ের আইনের অগ্রগতিটাও তেমনভাবে হচ্ছে না। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চিকির‌্যাসকদের অবহেলার কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে জনস্বার্থে অনেক মামলা হয়েছে। তা ছাড়া বিভিন্ন সময়ে ভারতের আদালত এসব মামলার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রোগী বা ব্যক্তির উপকারও করেছেন। আবার ভারতে ‘কনজিউমার প্রোটেকশন অ্যাক্ট (১৯৮৬)’ নামক আইনের আওতায় ডাক্তারের অবহেলার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত রোগীরা কনজিউমার আদালতে গিয়ে কোনো প্রকার ফি ছাড়াই চিকির‌্যাসকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারেন এবং অনেক রোগী এ বিষয়ে প্রতিকারও পেয়ে থাকেন। কিন্তু এ দেশে এ ধরনের কোনো আইন নেই। বর্তমানে আমাদের দেশে এ-সংক্রান্ত যে আইন প্রচলিত আছে তারও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেহেতু চিকির‌্যাসা মানুষের একটি অন্যতম প্রধান মৌলিক চাহিদা এবং এ দেশে চিকির‌্যাসার ক্ষেত্রে অহরহই চিকির‌্যাসকের অবহেলার ঘটনা ঘটছে, ফলে এ ধরনের একটি আইনের প্রয়োজনীয়তা কোনোভাবেই উপক্ষো করা যায় না। কারণ কোনো চিকির‌্যাসকের অবহেলার কারণে যদি ওই চিকির‌্যাসকের বিরুদ্ধে আইনের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে অন্য চিকির‌্যাসকেরা এ ব্যাপারে সজাগ হবেন, রোগীর চিকির‌্যাসার সময় যথাযথ মনোযোগ দেবেন, যত্নবান হবে। এর পাশাপাশি চিকির‌্যাসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) যদি এ ব্যাপারে সচেতন ভূমিকা পালন করে তবে সে ক্ষেত্রে চিকির‌্যাসা পেশায় কিছুটা হলেও জবাবদিহির সৃষ্টি হবে। তখন রোগীদের ওপর হয়রানির বিষয়টি অনেকটাই লাঘব হবে।
সর্বোপরি, চিকির‌্যাসকদের মেডিকেল এথিক্স সর্বদা মেনে চলে এবং রোগীর প্রতি যথেষ্ট আন্তরিক ও যত্নবান হওয়া উচিত। অর্থের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি—এ বিষয়টিও তাঁদের সর্বদা মান্য করা উচিত। চিকির‌্যাসকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সরকার কর্তৃক তাঁদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও নিশ্চিত করা জরুরি। তবে জনগণের চিকির‌্যাসাসেবা নিশ্চিত করতে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে চিকির‌্যাসকদের মনমানসিকতার দিক থেকে সতর্ক হওয়া। অন্যথায় কোনো সতর্কবাণীই তাঁদের সতর্ক করতে পারবে না। চিকির‌্যাসকসহ সবারই এ কথা স্মরণ রাখা উচিত যে মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য।
 কুদরাত-ই-খুদা: পিএইচডি গবেষক (আইবিএস), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
kekbabu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.