স্বাধীনতার ৪০ বছর-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। গোলাম মোস্তফা, বীর প্রতীক যুদ্ধক্ষেত্রে অবিচল এক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল রাতের অন্ধকারে অবস্থান নিতে থাকল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানের অদূরে। ভোর হওয়ার আগে পাকিস্তানি সেনারা তাদের আকস্মিক আক্রমণ করল। নিমেষে সেখানে শুরু হয়ে গেল ভয়াবহ যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলে আছেন গোলাম মোস্তফা। তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা


সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ মোকাবিলা করতে থাকলেন। শত্রু বেশ বেপরোয়া। প্রচণ্ড লড়াইয়ে শহীদ হলেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। আহত হলেন মোস্তফাসহ আরও কয়েকজন। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের শেষ দিকে। কানাইঘাটে।
কানাইঘাট সিলেট জেলার অন্তর্গত একটি থানা (বর্তমানে উপজেলা)। সুরমা নদীর তীরে, জৈন্তাপুর-জকিগঞ্জ সংযোগ সড়কে। সীমান্ত এলাকা। সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্য। এখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের শক্ত এক প্রতিরক্ষা অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের কয়েকটি দল সীমান্ত এলাকা থেকে বিভিন্ন দিক দিয়ে সিলেট অভিমুখে অগ্রসর হয়। জেড ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আসতে থাকে আটগ্রাম-চরঘাট-সিলেট অক্ষ ধরে। পথিমধ্যে কয়েক স্থান থেকে পাকিস্তানি সেনাদের বিতাড়িত করে ২৫-২৬ নভেম্বর তারা পৌঁছে যায় গৌরীপুরে। সেখান থেকে কানাইঘাটের দূরত্ব দুই মাইল। মুক্তিযোদ্ধারা সুরমা নদীর উত্তর ও দক্ষিণ তীরে অস্থায়ী প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। ২৬-২৭ নভেম্বর ভোরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দল তাদের মূল প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে এসে আকস্মিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের সামনের দুটি কোম্পানিকে প্রায় ঘেরাও করে ফেলে। তাদের অতর্কিত আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রবর্তী দল (আলফা ও ডেলটা কোম্পানি) নাজুক অবস্থায় পড়ে যায়। এমন অবস্থায় বিচলিত না হয়ে গোলাম মোস্তফাসহ মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকেন। এ রকম যুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ ছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা থাকে না। গোলাম মোস্তফা ও তাঁর সহযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে তাই করতে থাকেন। ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলতে থাকে। প্রচণ্ড লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনীর আলফা কোম্পানির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানসহ (বীর উত্তম) বেশ কয়েকজন শহীদ হন এবং আহত হন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। গোলাম মোস্তফা নিজেও পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে আহত হন। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের অপর দল লেফটেন্যান্ট ওয়াকার হাসানের (বীর প্রতীক, পরে মেজর) নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর পাল্টা ঝটিকা আক্রমণ চালায়। তাঁদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তখন পাকিস্তানি সেনারা পশ্চাদপসরণ করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর সারওয়ারসহ অসংখ্য সেনা নিহত হয়। মুক্তিযুদ্ধে কানাইঘাট যুদ্ধ অন্যতম এক যুদ্ধ।
গোলাম মোস্তফা চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। নবীন সৈনিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। ভারতে যাওয়ার পর পুনর্গঠিত হয়ে প্রথম যুদ্ধ করেন জামালপুর জেলার কামালপুরে। পরে জেড ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যোদ্ধা হিসেবে আটগ্রাম-চারগ্রামসহ আরও কয়েক স্থানে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য গোলাম মোস্তফাকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ১৩৫।
গোলাম মোস্তফা ২০০৫ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার বাঘপাছরা গ্রামে। ডাকঘর নান্দিয়াপাড়া বাজার। তাঁর বাবার নাম আবদুুল রেজ্জাক, মা রমিলা বেগম। স্ত্রী কোহিনূর বেগম। তাঁদের তিন ছেলে ও চার মেয়ে। তাঁর স্ত্রী সরকারি ভাতা পান। গ্রামবাসী গোলাম মোস্তফার বীরত্ব সম্পর্কে জানেন। তাঁর জন্য তাঁরা গর্ববোধ করেন।
সূত্র: ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী), লেখক-গবেষক, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.