বড় জমায়েতের পর টানা অবস্থানের পরিকল্পনা ছিল

রাজধানীতে আচমকা বড় ধরনের জমায়েত, তারপর টানা অবস্থান ও গণবিক্ষোভের পরিকল্পনা নিয়েছিল প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। গতকাল রোববারের মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্বঘোষিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠান উপলক্ষ করে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নেরও উদ্যোগ নেয় দলটি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জানতে পেরে তা দৃশ্যত ব্যর্থ করে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিএনপি, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে।


সূত্রগুলো জানায়, ঢাকায় এমন জমায়েত করতে পারলে তা অবস্থান কর্মসূচি হিসেবে অন্তত তিন দিন টানা চালানোর পরিকল্পনা ছিল বিএনপির। এর মাধ্যমে দলটি ‘সরকার পতনের আন্দোলন’ ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিল। এ লক্ষ্যে মহানগরের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও থানাপর্যায় থেকে শুরু করে আশপাশের জেলাগুলো থেকেও দলীয় লোকজনকে ঢাকায় আনতে কয়েক সপ্তাহ ধরে নিভৃতে প্রস্তুতি নেওয়া হয়। ঢাকার আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে লোক আনার জন্য প্রায় আড়াই শ গাড়িও ভাড়া করা হয়েছিল। সমবেত জনতার জন্য তিন দিনের খাবারের ব্যবস্থাসহ আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়।
তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বড় ধরনের জমায়েত বা টানা অবস্থান কর্মসূচির পরিকল্পনা বা প্রস্তুতির কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, সরকারের পক্ষ থেকে এসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
তাহলে খাবারদাবারের আয়োজন কেন করা হয়েছে—এ প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘শুধুমাত্র এক দিনের, মুক্তিযোদ্ধাদের গতকাল দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হচ্ছিল।’
গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র দাবি করেছে, শনিবার রাতে বিএনপির এ পরিকল্পনা সম্পর্কে আঁচ করতে পারে তারা। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে আলোচনার পর ওই রাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে। রাতেই রাজধানীর বিভিন্ন হোটেলে অভিযান চালিয়ে অনেককে আটক করা হয়।
ঢাকার আশপাশের জেলা-উপজেলাগুলোর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সূত্র জানায়, ঢাকায় ‘অঘোষিত জনসমাগম’ ঠেকাতে পুলিশকে শনিবার রাতে সতর্ক করা হয় এবং গভীর রাতেই পুলিশ উদ্যোগ নেয়। তারা নিজ নিজ জেলা-উপজেলা থেকে ঢাকামুখী বিএনপির নেতা-কর্মীদের গাড়ি পথে আটকে দেয়। যেসব গাড়ি পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে ভোরে ঢাকার প্রবেশপথে পৌঁছে গিয়েছিল, সেগুলোকে সেখানে থামিয়ে ফেরত পাঠানো হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, এসব গাড়িতে দলের কোনো ব্যানার ব্যবহার করা হয়নি। কোনো স্লোগানও ছিল না কর্মীদের মুখে। অনেকটা নীরবে তারা ঢাকায় রওনা হয়। স্থানীয় সাংবাদিকেরাও বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঢাকায় দলীয় কর্মসূচিতে আসার তথ্য জানতেন না।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির পরিকল্পনা ছিল, মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার নামে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এসে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মাঠসহ আশপাশের সড়কে অবস্থান নেবে। সেখান থেকে সরকার পতনের ডাক দিয়ে প্রেসক্লাব ও সচিবালয়ের আশপাশে অবস্থান নিয়ে ঢাকা অচল করে দেওয়া হবে।
ঢাকার পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে অন্য জেলা-উপজেলা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যাতে আনা না যায়, সে জন্য একই সঙ্গে একাধিক বড় শহরেও জমায়েত এবং বিক্ষোভের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পূর্বঘোষণা ছাড়াই গতকাল সকাল থেকে চট্টগ্রামে বিএনপির উদ্যোগে দলীয় কার্যালয়ের সামনে ‘সমাবেশ ও উৎসব’ শুরু করা হয় বলে ওই কর্মকর্তা মনে করছেন।
চট্টগ্রামে বিএনপির একজন নেতা সাংবাদিকদের বলেছেন, সকাল থেকে দলের কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ শুরু করার জন্য রাত একটায় ঢাকা থেকে তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশমতো চট্টগ্রাম বিএনপির রাজনীতিতে তিনটি ধারার তিন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এ মঞ্চে একত্র হন।
সিলেটেও বিক্ষোভের প্রস্তুতি নেওয়া হয় এবং সেখানে বাসে আগুন দিলে একজন যাত্রী পুড়ে মারা যান।
অবশ্য ঢাকায় তিন দিনের অবস্থান পরিকল্পনা ও নিভৃতে প্রস্তুতির কথা অস্বীকার করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গতকালের কর্মসূচি ছিল পূর্বঘোষিত। তাঁদের পরিকল্পনা ছিল বিজয়ের ৪০ বছরে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বড় সমাবেশ করার। এ জন্য গতকাল সারা দেশ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকায় আসছিলেন। কিন্তু পথে বিভিন্ন স্থানে পুলিশ তাঁদের বাধা দেয়। তাঁদের বহনকারী গাড়ি আটক করে। ফলে তাঁরা আসতে পারেননি। এ সময় বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীকে আটক ও নির্যাতন করা হয়েছে বলেও মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেন।
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, চারদলীয় জোটের চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চ শেষে ঢাকা ঘেরাও বা ‘চল চল ঢাকা চল’ কর্মসূচি দেওয়ার কথা ছিল। এর আগের রোডমার্চ কর্মসূচিতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তা ঘোষণাও দিয়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া ও তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার বিচার কার্যক্রম গতি পাওয়ায় দলটি ঢাকা অবরোধ বা অবস্থান পরিকল্পনা এগিয়ে আনে।
সূত্রটির মতে, বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, সরকার দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সাজার ব্যবস্থা করে তাঁদের আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্র করছে। এ জন্য সরকার পতনের লক্ষ্যে বড় ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায় বিএনপি। এ ক্ষেত্রে মিসরের সাম্প্রতিক গণ-আন্দোলন ও থাইল্যান্ডের লাল শার্ট আন্দোলনের ধরন থেকেও কিছু ধারণা নেওয়া হয়।
সূত্রটির তথ্য অনুযায়ী, বিএনপির হিসাবে ঢাকায় এক লাখ লোক জড়ো করে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করলে সারা দেশের নেতা-কর্মীরা যাঁর যাঁর এলাকায় মাঠে নেমে পড়বেন। আর আন্দোলনকারীরা শক্তি প্রদর্শন করতে পারলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে যাবে। তখন কেউ কেউ আন্দোলনের প্রতি সংহতিও প্রকাশ করতে পারেন বলে দলটির আশা ছিল।
দায়িত্বশীল একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা দাবি করেন, তাঁদের কাছে তথ্য আছে, বিএনপি-জামায়াত রাজনৈতিক প্রস্তুতির পাশাপাশি দাঙ্গা-হাঙ্গামারও প্রস্তুতি নিয়েছিল, যাতে রাজনৈতিক কর্মসূচি বা বিক্ষোভের পাশাপাশি একযোগে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ককটেল-বোমা ফাটিয়ে, গাড়ি পুড়িয়ে অরাজক ও আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যায়। গতকাল সকাল থেকে ঢাকায় কিছুটা হলেও এমন আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
ওই কর্মকর্তার দাবি, বিএনপির যেমনটি আশা ছিল, শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে রাজধানীবাসী দেখবে, হাজার হাজার জনতা শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে অবস্থান নিয়ে আছে, তেমনটি হতে দেননি তাঁরা।
অবশ্য মির্জা ফখরুল দাবি করেন, এসব তথ্য ঠিক নয়। সরকারের পক্ষ থেকে এসব অপপ্রচার চালানো হয়েছে।
গতকাল বিকেলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। পুলিশ সেখানে কাউকে বাধা দেয়নি।

No comments

Powered by Blogger.