পুনশ্চঃ লিয়ার লেভিন by ক্যাথরিন মাসুদ

৯৯০ সালের শেষ দিক। আমি আর তারেক তখন আমেরিকায়। এক দিন তারেকের চাচাতো ভাই বেনুর পুরোনো বন্ধু তারিক আলির সঙ্গে দেখা। তিনি পার্শ্ববর্তী শহর লরেন্সভিলে একটা ওষুধের ফার্মে কাজ করতেন। তারিক ভাই আমাদের পরের শনিবার ছুটির দিনে তাঁর ওখানে দুপুরে খাওয়ার দাওয়াত করলেন। যথারীতি পরের শনিবার তারিক ভাইয়ের বাসায় খাওয়া-দাওয়া সেরে বাংলাদেশের গল্প, ঢাকার গল্প আর দেশে ফেরার স্বপ্ন নিয়ে মেতে উঠেছিলাম।


একসময় গল্পের মোড় ঘুরল মুক্তিযুদ্ধের দিকে। একাত্তরে কলকাতায় গড়ে ওঠা ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামক একটি গানের দলের প্রধান গায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বেনু ভাই। এই দলের শিল্পীরা সীমান্ত এলাকায়, ট্রেনিং ক্যাম্পে, শরণার্থী শিবিরে, এমনকি সুযোগ হলে মুক্তাঞ্চলেও গান গেয়ে সবার মনোবল অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করতেন। তারিক আলি মূলত গায়ক না হয়েও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন এই দলের সঙ্গে। তারিক ভাই বললেন, তখন একটা মার্কিন শুটিং দলও তাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছিল। তারিক ভাই যতদূর মনে করতে পারলেন, তার নাম ছিল লিয়ার লেভিন। সঙ্গে সঙ্গেই আমরা কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। খুব জানতে ইচ্ছে করছিল ফুটেজগুলোর কী হলো? হয়তো যুদ্ধসংক্রান্ত তথ্যাগারের ক্যাটালগে পড়ে আছে! হয়তো লিয়ার আর নিউইয়র্কে থাকেই না! হয়তো বেঁচেও নেই।
পরের এক কি দুই সপ্তাহ তারেক আর আমি লিয়ার লেভিনের কথা প্রায় ভুলেই ছিলাম। কিন্তু এক শনিবারে মনে পড়তেই সঙ্গে সঙ্গে ফোনবুক খুলে ‘এল’ আদ্যাক্ষরের সারিতে চোখ বুলাতে শুরু করলাম। তালিকায় কাঙ্ক্ষিত নামটি দেখে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। ‘লিয়ার লেভিন’! লিয়ার লেভিন প্রোডাকশনস! টেলিফোনে কথা বলায় আমি বরাবরই অস্বস্তিবোধ করি। তাই ফোনটা তারেককে দিলাম। তারেক: আমি কি লিয়ার লেভিনের সঙ্গে কথা বলতে পারি?
লিয়ার: বলছি।
তারেক: আপনি কি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন এবং শুটিং করেছিলেন?
লিয়ার: হ্যাঁ, কেন?
তারেক: আমি একজন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা, বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমি বেনুর চাচাতো ভাই। বেনুর কথা মনে আছে?
বেনুর নাম শুনেই লিয়ার যেন কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। যা টেলিফোনের এ-প্রান্ত থেকেও অনুভব করে তারেক।
লিয়ার: ১৯৭১ সালে আমি যুবক, বয়স ৩০ বছর। আমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি করতে কলকাতায় গিয়েছিলাম। এত দিন পর আজ বাংলাদেশের কেউ একজন আমাকে ফোন করল। আমি প্রায় ২০ বছর এই ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম।
লিয়ারের ফুটেজ দেখতে চাইল তারেক, ওগুলো নিয়ে কিছু করতে চায় ও। উত্তরে লিয়ার বলল, ‘আমার ফুটেজ যদি বাংলাদেশের কোনো কাজে লাগে, আমি খুবই খুশি হব।’
আমরা ঘণ্টা খানেকের মতো ফুটেজ দেখলাম। ফুটেজ দেখার পর আমাদের ঘোর কাটতে সময় লাগল! আমরা ধরে নিয়েছিলাম ২০-৩০ মিনিটের নিউজ রিল পাব। যখন শুনলাম, এ রকম আরও ১৭-১৮ ঘণ্টার ফুটেজ রয়েছে লিয়ারের কাছে, আমাদের আবেগ ও উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছিলাম না।
লিয়ারের সঙ্গে টেলিফোন আলাপের পর আমরা নিউইয়র্কের ম্যানহাটানে তাঁর বাসায় নিয়মিত যাতায়াত শুরু করি। আমাদের কাজ ছিল, ফুটেজগুলো দেখা ও তালিকা তৈরি করা। লিয়ারের বেসমেন্টে দেখলাম, অনেক কার্ডবোর্ড বাক্স। প্রতিটি বাক্সের গায়ে স্পষ্ট হাতে লেখা ‘বাংলাদেশ’, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরম যত্নে তুলে রাখা আছে। অবশ্য লিয়ারের ফুটেজের প্রধান অংশে ঠিক মুক্তিযুদ্ধ কিংবা গানের দল ছিল না। ফুটেজগুলো জুড়ে ছিল শরণার্থী শিবিরের নিত্যনৈমিত্তিক জীবন, গ্রামবাংলার দৃশ্য। লোকজন ধান মাড়াই করছে, বাজারে যাচ্ছে, মেঠোপথে ধুলো উড়িয়ে ছুটছে গরুর গাড়ি, নদীতে লোকজন গোসল করছে। শরণার্থী শিবিরের খুঁটিনাটি অনেক বিষয়ের ফুটেজ পাওয়া গেল। বাংলাদেশ থেকে ফেরার কয়েক মাস পর লিয়ার তাঁর ফুটেজ নিয়ে টানা এক মাস সম্পাদনা করে প্রায় এক ঘণ্টার একটি ছবিও দাঁড় করিয়েছিলেন। জয় বাংলা নামের এ ছবি ছিল নৈসর্গিক ও নৃতাত্ত্বিক ধাঁচের। যুদ্ধের পরোক্ষ পটভূমিতে অত্যন্ত মানবিক ভঙ্গিতে তিনি বাংলাদেশের মানুষের জীবন-চেতনা, উদ্দীপনা আর সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
* প্রথম আলোয় প্রকাশিত (১৬ ডিসেম্বর, ২০০৫) লেখার সম্পাদিত রুপ।

No comments

Powered by Blogger.