প্রশাসক নিয়োগে কার লাভ কার ক্ষতি?-জেলা পরিষদ by আবু সাঈদ খান

ণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জনগণের একাত্মতায় মতামতের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, আর জনমতকে যাচাই না করে ওপর থেকে কিছু চাপিয়ে দেওয়ার পেছনে মহৎ উদ্দেশ্য থাকলেও তা গণতন্ত্রসম্মত নয়। এ নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য আছে, তা প্রমাণ করতে পারেনি শাসক দল। বলেছে, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্য এটি করা হয়েছে। হ্যাঁ, আমাদের সংবিধানে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের নির্দেশনা রয়েছে। তবে প্রশাসক নিয়োগের কথা কোথাও নেই


বিজয়ের মাস ডিসেম্বরজুড়ে সংবাদপত্র, বৈদ্যুতিন মাধ্যম, সভা-সেমিনারে যখন হিসাব-নিকাশ, মূল্যায়ন-পুনর্মূল্যায়ন চলছে_ স্বাধীনতার চলি্লশ বছরে আমরা কী পেয়েছি, কী পাইনি বা পেতে পারতাম, তখনই ঘোষিত হলো নতুন এক সরকারি ফরমান। এ ফরমানে পার্বত্য তিনটি জেলা বাদে ৬১টি জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্তরা সবাই আওয়ামী লীগের নেতা। কেউ গত নির্বাচনে সাংসদ পদপ্রার্থী ছিলেন, কেউবা স্থানীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হলেও সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত ছিলেন। জেলা পরিষদের প্রশাসক পদ তাদের কাছে বড় প্রাপ্তি। এ পদে বসে তারা গাড়ি পাবেন, অফিস পাবেন, ক্ষমতার মালিক হবেন। নির্বাচন হলে তাতে জিতেও আসতে পারেন। অবশ্য সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাদের জয় হবে কি-না তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগের মধ্য দিয়ে দলীয় নেতাদের উপকার হলো, সরকার দল তোষণের উপায় পেল, কিন্তু জনগণের কী লাভ হলো?
জেলা পরিষদে অনির্বাচিত প্রশাসক নিয়োগের আগে জনমত যাচাই করা হয়নি, আগামী ছয় মাসে নির্বাচন হবে কি-না তাও নিশ্চিত নয়। ফলে প্রাথমিকভাবে জনগণ ভোটাধিকার হারাল। প্রশ্ন হলো, জনগণ বা জনগণের কোনো অংশ জেলা পরিষদে কি কখনও প্রশাসক নিয়োগের দাবি তুলেছে? কিংবা ক্ষমতাসীন দল কখনওবা নির্বাচনী ইশতেহারে এমন ঘোষণা দিয়েছে? দেয়নি। তারপরও এমন একটি অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হলো। জনগণ, সংবাদমাধ্যম দূরের কথা মহাজোটের দলগুলো এমনকি আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও বিষয়টি জানতেন না। মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আমরা কী করে জানব, আওয়ামী লীগেই আলোচনা করা হয়নি।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জনগণের একাত্মতায় মতামতের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, আর জনমতকে যাচাই না করে ওপর থেকে কিছু চাপিয়ে দেওয়ার পেছনে মহৎ উদ্দেশ্য থাকলেও তা গণতন্ত্রসম্মত নয়। এ নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য আছে, তা প্রমাণ করতে পারেনি শাসক দল। বলেছে, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্য এটি করা হয়েছে। হ্যাঁ, আমাদের সংবিধানে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের নির্দেশনা রয়েছে। তবে প্রশাসক নিয়োগের কথা কোথাও নেই। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, '... প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।' অনুচ্ছেদ ৫৯তে আছে, 'আইন অনুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।' আর অনুচ্ছেদ ১৫২ স্পষ্ট করেছে যে, 'প্রশাসনের একাংশ অর্থ জেলা কিংবা সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধনকল্পে আইনের দ্বারা অভিহিত অন্য কোন এলাকা।' শিশুরও বোধগম্য যে, সংবিধান অনুযায়ী জেলা ও অন্য কোনো প্রশাসনিক স্তরে প্রশাসক নিয়োগের সুযোগ নেই। তাই এটি সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, সাংঘর্ষিকও বটে। এ ব্যাপারে বহুল আলোচিত কুদরতে ইলাহি পনির বনাম বাংলাদেশ মামলার রায় (১৯৯২) প্রণিধানযোগ্য। সেখানে সরকারি কর্মকর্তা বা আজ্ঞাবহদের দিয়ে প্রশাসন পরিচালনার প্রবণতা খারিজ করে ৬ মাসের মধ্যে জেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের সব স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধির সমন্বয়ে পরিষদ গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। ১৯৯২-এর পর একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। কিন্তু আদালতের রায়কে আমলে নেয়নি কোনো সরকার। তবে ২০০০ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে জেলা পরিষদ আইন পাস হয়েছিল। আইনটি ত্রুটিপূর্ণ হলেও নির্বাচিত জেলা পরিষদের বিধান এতে সনি্নম্নবেশিত হয়েছে। সেটিকে শিকেয় তুলে আজ যেটি করা হলো, তা ১৯৮৮ সালে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিয়োগের সঙ্গে তুলনীয়। তবে এবারের নিয়োগে এরশাদের জাতীয় পার্টিও ক্ষুব্ধ। তাদের ক্ষোভ নীতিগত নয়_ প্রশাসক নিয়োগের বিরোধিতা নয় বরং মহাজোটের হিস্যা না দেওয়ায় জাতীয় পার্টি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।
সরকার জনমতকে তোয়াক্কা না করে ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তিকরণ ও প্রশাসক নিয়োগের পর জেলাগুলোতেও অনির্বাচিত প্রশাসক নিয়োগ করল। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের যুক্তি ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনির্বাচিত। তবে সিটি করপোরেশন ও জেলা পরিষদে অনির্বাচিত কর্তৃপক্ষকে বসানোর উদ্যোগে তারা দ্বিধান্বিত হলেন না কেন? এর কারণ কারও অজানা নয়। জেলা পরিষদে যাদের নিয়োগ দেওয়া হলো, তারা দলীয় নেতা। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সরকার জনমত, সংবিধান, আদালতের রায় সব অগ্রাহ্য করেছে, যা ক্ষমতার অপব্যবহারের শামিল।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়, তবে এ পাঁচ বছরে যা খুশি করার অধিকার তাদের থাকে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারকে প্রতিনিয়ত জনমতের দিকে নজর রাখতে হয়, নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করতে হয়। ভিন্ন মতের সঙ্গে 'সওয়াল-জওয়াব' করতে হয়। সবার ঊধর্ে্ব স্থান দিতে হয় জনস্বার্থ। সবচেয়ে বড় কথা, সংবিধান লঙ্ঘন না করে শাসনকার্য পরিচালনা করতে হয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকার গণতান্ত্রিক রীতিনীতির তোয়াক্কা করছে না। জনমতকে আমলে নিচ্ছে না, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম কী বলছে তা শুনছে না, এমনকি সংবিধান মানার দিকেও তাদের ঝোঁক নেই।
কে না বোঝে, জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগের পেছনে দলীয় স্বার্থই ক্রিয়াশীল। সরকার বলছে যে, ৬ মাস পরে যথানিয়মে নির্বাচন হবে। তাই যদি হয়, তবে এই স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রশাসক নিয়োগ কেন প্রয়োজন পড়ল? এর আগে সরকার উপজেলায় মাথার ওপর সাংসদদের বসিয়ে দলীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করে, সেখানে প্রশাসক নিয়োগ করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইছে। জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ সেই ধারাবাহিকতায় নতুন সংযোজন। এ ধরনের দলীয়করণের মানসিকতা গণতন্ত্র ও স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণের ক্ষেত্রে বড় বাধা।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে (২০০৮) বলা হয়েছে, 'ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদকে শক্তিশালী করা হবে। জেলা পরিষদকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন-শৃঙ্খলা ও সব ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে।' এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ গত তিন বছরে নেওয়া হয়নি। এমনকি এ বিষয়ে তেমন আলোচনাও চোখে পড়েনি। সেদিকে না গিয়ে হঠাৎ করে প্রশাসক নিয়োগের এমন সিদ্ধান্ত কেন?
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার অনুসরণ করলেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারত সরকার। যেমন_ জেলা পরিষদের কাছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন-শৃঙ্খলা এবং উন্নয়নমূলক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের যথাযথ ক্ষমতা অর্পণ। জেলাগুলোতে এখনও ঔপনিবেশিক ধাঁচের আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন বহাল তবিয়তে আছে। জেলা প্রশাসনে কর্তাব্যক্তি ডেপুটি কমিশনার, যা বাংলায় জেলা প্রশাসক করে আরও ভারিক্কি করা হয়েছে। বর্তমান প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কার্যত ডেপুটি কমিশনারের কাছেই জেলার প্রশাসনিক কর্তৃত্ব রয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে জেলা পরিষদের কোনো ভূমিকা নেই। তাই আজ জরুরি ছিল জেলা পরিষদের ওপর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব অর্পণসহ অধিকতর ক্ষমতায়ন। সেদিকে নজর না দিয়ে জেলা পরিষদকে দলীয়করণ করার এ চেষ্টা কোনো শুভ ফল বয়ে আনবে না। সরকার ভেবে থাকতে পারে, দলের নেতাদের কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এতে মিটল। বাস্তবে তা নয়, বরং এতে দলের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বেড়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে সেই আলামত পাওয়া গেছে। দলের ভেতরের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। আসলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে ওপর থেকে নিয়োগদানের এ পদক্ষেপ প্রশাসন ও দল কোথাও সুস্থতা নিশ্চিত করবে না। বরং বহুমুখী জটিলতা দেখা দেবে।
এ ধরনের পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আরও দূরত্ব বাড়ছে। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বিরোধী দল ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার আভাস দিয়েছে। জেলা পরিষদে নির্বাচন দিলে সেখানেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বিরোধী দলকে দূরে রেখে নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে সরকার তুষ্ট থাকতে পারে; কিন্তু আখেরে তার ফল ভালো হবে না।
গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে সাধারণ নির্বাচনের প্রক্রিয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পরিবর্তনেও রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য দরকার।
নির্বাচন পুনর্গঠন প্রশ্নে রাষ্ট্রপতি সংলাপের কথা বলেছেন। সেটি শুভ উদ্যোগ। কিন্তু সংলাপের পাশাপাশি যদি হীন রাজনৈতিক স্বার্থে স্বেচ্ছাচারমূলক পদক্ষেপ অব্যাহত থাকে, তবে তা দেশের সামগ্রিক রাজনীতির জন্যই হুমকিস্বরূপ।
আমরা দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দল তো বটেই, নাগরিক সমাজের সঙ্গে সংলাপ প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, জনমত যাচাই, সরকার ও বিরোধী দলের অংশগ্রহণ যত বেশি করা যায়, ততই তা মঙ্গলজনক।

আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.