ভিন্নমত-ডাক্তারি পেশা ও হাসপাতাল ব্যবসাকে তদারকির মধ্যে আনুন by আবু আহমেদ

মাদের সরকার স্বাস্থ্যখাতে বিরাট অঙ্কের বাজেট ব্যয় করছে। কিন্তু সত্য হলো, ওই বাজেটের বিরাট অংশ শুধু জলেই যাচ্ছে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবার হ-য-ব-র-ল অবস্থা। সরকারি অর্থায়নে অনেক মেডিক্যাল কলেজ এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ওইসব প্রতিষ্ঠানে অনেক শিক্ষিত ডাক্তার-অধ্যাপক প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন। তবে উনারা যখন সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী দেখেন, তখন অবস্থাপন্ন রোগীরা উনাদের রোগী হতে চান না।


আর উনারা যখন বিকাল ৫-৮টায় বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বসেন, তখন অনেকে ৫০০-৮০০ টাকা ফি দিয়ে উনাদের রোগী হওয়ার জন্য অনেক পেরেসান হয়। কেন এই অবস্থা হবে? দুই কারণে, এক রোগীর বিশ্বাস, সরকারি হাসপাতালগুলোতে অধ্যাপক ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলার পরিবেশ নেই। দুই, রোগী এও বিশ্বাস করে যে ওইসব হাসপাতালে ডাক্তার সাহেব মনোযোগ দিয়ে রোগীর কথা শুনবে না। তাই যেটা দেখা যায় সেটা হলো, সরকারি হাসপাতালগুলোর OPD-তে শুধু গরিব রোগীদের ভিড়। অন্য রোগীরা অপেক্ষা করে পয়সা দিয়ে হলেও ওই ডাক্তার সাহেবকে একটি প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ধরবে।
অনেক প্রাইভেট হাসপাতালেই ডাক্তার সাহেব সরাসরি উনার ফি-টা নেন। উনি না নিলেও উনার 'ছেলেটি' নেন। প্রশ্ন হতে পারে, এতে হাসপাতাল বা ক্লিনিকের কী লাভ হয়? জিজ্ঞাসা করে যা জেনেছি সেটা হলো, ওই ডাক্তার সাহেব কজন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারলেন বা কজন রোগীকে কত কত ক্লিনিক্যাল রিপোর্টের জন্য রেফার করলেন, তার ওপর হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের আয় নির্ভর করছে। তবে এসব আয়-রোজগারে ট্যাঙ্ দেওয়া হচ্ছে কি না সে ব্যাপারে তেমন কোনো প্রমাণ দেখা যায় না। ট্যাঙ্ কর্তৃপক্ষ ভ্যাট ও আয়করের ক্ষেত্রে এই পেশা ও ব্যবসাকে কিভাবে দেখছে, তা আমাদের মতো লোকের জানা নেই। একটা অভিযোগ অহরহ ওঠে, ডাক্তারের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে। হতেও পারে। কিন্তু এটি প্রমাণ করবে কে? নিশ্চয় আরেক ডাক্তারই কেবল এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ হতে পারেন, যিনি বলবেন হ্যাঁ, ডাক্তারের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে। অবহেলা ও ভুল চিকিৎসা তো হতেই পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পরীক্ষা ও তদারকি কর্তৃপক্ষ কোনটি? আমার জানা মতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং আইন দ্বারা সংজ্ঞায়িত কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। ডাক্তার মেরে কিংবা কোর্টে কেস করে এ সমস্যার সমাধান হবে না। সমাধান হলো, এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়ে আইন দ্বারা একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা বা কমিশন স্থাপন করা, যে কমিশন হাসপাতালের ব্যবসা ও ডাক্তারদের পেশাগত দায়িত্ব তদারকি করবে। ওই কমিশন ডাক্তারের প্র্যাকটিস করার লাইসেন্স যেমন বাতিল করতে পারবে, তেমনি হাসপাতালগুলোর ব্যবসাকেও নিয়মের মধ্যে আনতে পারবে।
আজকে যে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে হাজার হাজার রোগীর প্যাথ টেস্ট এবং কেমিক্যাল টেস্ট দেওয়া হচ্ছে, ওইগুলোর সঠিকতা কে নিরূপণ করছে? একটা সিল তো নিচে থাকে বটে। তবে ওই সিলটি যে প্রকৃতই ওই শিক্ষিত ডাক্তার বা সিএ-র, তা বুঝব কী করে? এসব দেখার ব্যবস্থা না করে বাংলাদেশ অতি তাড়াতাড়ি ব্যক্তিখাতে স্বাস্থ্যসেবার নামে এক বিরাট প্রাইভেট ব্যবসা করার সুযোগ করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে FDA কেন আছে? আমাদের দেশে কি FDA-এর সমকক্ষ বা সেই আদলের কোনো প্রতিষ্ঠান/সংস্থা আছে? এত সহজে বিশ্বে কোথাও মেডিক্যাল প্রেসক্রিপসন পাওয়া যায় না। আর মুদি দোকানের মতো এত ওষুধের দোকানও কি আপনারা বিশ্বের অন্যত্র কোথাও দেখেছেন? আজকে ওষুধ কম্পানিগুলো, হাসপাতাল এবং একশ্রেণীর ডাক্তার মিলে রোগী চিকিৎসার নামে শুধু রোগীই সৃষ্টি করে চলেছে। কে দেখার আছে এসব? প্রাইভেট সেক্টরে যেকোনো ব্যবসাকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, সেটা অর্থনীতি ও বাণিজ্যের বইগুলোতে অনেক লেখা আছে। আমার কাছে আশ্চর্য মনে হয় যারা এসব বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করেছে, তারা কী করে নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিহীন এত বড় একটা ব্যবসাকে চলতে দিচ্ছে? যুক্তরাজ্য থেকে আমাদের ডাক্তাররা MRCP, MGDG, FRCS ডিগ্রি আনেন। স্পেনে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কিভাবে তদারকি হয় সে ব্যাপারে তো কিছু হলেও জ্ঞান থাকার কথা। কিন্তু দেশে ফিরে সবাই উচ্চ ফি-তে রোগী দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ভালো করে রোগী দেখতে গেলে পাঁচ-আট_এই তিন ঘণ্টা বড়জোর ২০-২৫ জন রোগী দেখতে পারেন। কিন্তু উনাকে রোগী দেখতে হয় ৫০-৬০ জন। ফলে রোগীরা অসন্তুষ্টি নিয়েই ডাক্তার সাহেবের রুম থেকে ফিরে আসে। কিন্তু এই সমস্যার কী সমাধান? সেই সমাধান হতে পারে আরো বেশি বেশি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তৈরি করা। কিন্তু জাতি কী সেই দিকে যাচ্ছে? অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর ওষুধে বাজার ভরে গেছে। কেউ দেখার নেই। কে শিক্ষিত ডাক্তার, কে অশিক্ষিত ডাক্তার তাও বুঝার উপায় নেই। অনেক কথিত বড় ডাক্তারও অনৈতিক পেশায় নিয়োজিত। একটা কেইস স্টাডি বলি। আলীম সাহেব তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে গেলেন একটি মাঝারি মানের বেসরকারি হাসপাতালের একজন মহিলা গাইনি বিশেষজ্ঞের কাছে। ওই বিশেষজ্ঞ একটা সরকারি হাসপাতালের মধ্যম মানের অধ্যাপক। অনেক রোগী তাঁর। তবে সরকারি হাসপাতালের পর উনি যখন বিকালে বসেন তখন আলীমের স্ত্রীকে বিরাট এক ল্যাব পরীক্ষার লিস্ট ধরিয়ে দিলেন। বলে দিলেন এই হাসপাতালে নয়, পাশের অন্য একটি হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ওইসব পরীক্ষা করাতে হবে। আলীমের স্ত্রী বললেন, ৩০ শতাংশ পরীক্ষা তো উনি মাত্র দুই মাস আগেই অন্য একটি বড় হাসপাতাল থেকে করিয়েছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার শুধু শুনলেন, বললেন যা লেখা আছে সবই করাতে হবে। শেষ পর্যন্ত উনি সবই করালেন, বিল এল ১২ হাজার টাকা। পরে ডাক্তার সাহেব যে হাসপাতালে বসেন সেই হাসপাতালের প্রশাসক ওই বিল ও রেফার করা দেখে গাইনি বিশেষজ্ঞের ওপর অনেক অসন্তুষ্ট হলেন। আলিম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, উনি বাইরে থেকে এসব পরীক্ষা করালেন, তাহলে আপনাদের পোষায় কিভাবে? উত্তর এল, উনার মাধ্যমে রোগী ভর্তি করে। পরে আলিম সাহেব শুনলেন, ওই বিশেষজ্ঞ অনেক রোগীকে সিজার করাতে দুই-পাঁচ দিনের জন্য ওই হাসপাতালে ভর্তি করান। উনার সিজার করার সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। দেখলেন তো ওই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার অন্যদিক দিয়ে হাসপাতালকে পুষিয়ে দিচ্ছে। তাহলে প্যাথলজিক্যাল টেস্টের ১২ হাজার টাকার ৩০ শতাংশ বিশেষজ্ঞ নিলে ক্ষতি কী? কিন্তু ক্ষতি হলো কার? আলীম সাহেবের। উনাকে বিনা প্রয়োজনে কমপক্ষে বাড়তি চার হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। এই ডাক্তারের পেশা নৈতিক না অনৈতিক! তবুও রোগীদের তাঁর কাছে যেতে হচ্ছে। কারণ উপায় নেই।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.