আপাতত আসছেন না হিলারি, হাসিনাকে চিঠি-বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কে দূরত্ব by রাহীদ এজাজ

ওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের পর গণতন্ত্র ও সুশাসনে অগ্রগতির পাশাপাশি সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমনে কার্যকর পদক্ষেপ প্রত্যাশা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন অপেক্ষায় ছিল, রূপরেখা বাণিজ্য চুক্তি (টিকফা) সইয়ের মতো অমীমাংসিত বিষয়েও সুরাহা হবে। কিন্তু প্রত্যাশিত বিষয়গুলো পূরণের পরিবর্তে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকসহ কয়েকটি প্রসঙ্গ নিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে।
ঢাকা ও ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে, সাম্প্রতিককালে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের কাজের ক্ষেত্র ‘সংকুচিত হওয়ায়’ (শ্রিংকিং স্পেস) যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন করে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। সেই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত হবে কি না, এ নিয়েও সংশয় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এমন এক পরিস্থিতিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের লক্ষ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর শিগগিরই হচ্ছে না।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কিছু ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের উদ্বেগের বিষয়টি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে তিনি বলেছেন, পরিবেশ উন্নততর হলে ’৯৫ সালের মতো পুনরায় তাঁর বাংলাদেশ সফর নিশ্চিত করতে পারে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো এ প্রতিবেদককে জানিয়েছে, গত ১২ অক্টোবর ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে বৈঠকের পর হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিটি লেখেন। ওই বৈঠকে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, হিলারি সেগুলোর উল্লেখ করেন। ওয়াশিংটনের বৈঠকটি ফলপ্রসূ হয়নি বলে জানা গেছে।
হিলারির চিঠির বিষয়বস্তু: দুই দেশের সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করে গত ২৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি লেখেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। চিঠিতে তিনি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কিছু অর্জনের প্রশংসা করেছেন। বিশেষ করে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যে (এমডিজি) বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, সন্ত্রাসবাদ দমনে দুই দেশের সহযোগিতা এবং দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে নতুন মাত্রা নিয়ে ওয়াশিংটনের সন্তুষ্টির কথা উল্লেখ করেন হিলারি।
একই চিঠিতেই নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের কাজের ক্ষেত্র ‘সংকুচিত হওয়া’ যে ওয়াশিংটনকে বিচলিত করছে, সেটি উল্লেখ করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক হয়রানি ও সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার এবং কিছু বেসরকারি সাহায্য সংস্থার ওপর ক্রমবর্ধমান চাপের খবরে মার্কিন উদ্বেগের বিষয়টি তিনি তুলে ধরেন। তাঁর মতে, বাংলাদেশের বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলোর পাশাপাশি নাগরিক সমাজের সৃজনশীলতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পৃথিবীজুড়েই প্রশংসিত। এই পরিস্থিতিতে এ খবরগুলো যথেষ্ট বিচলিত করে।
দীপু মনির সঙ্গে বৈঠকের উল্লেখ করে হিলারি ক্লিনটন বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকে একজন নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ করাটা জরুরি, যিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন এবং যা ব্যাংকটিতে তার ৮০ লাখ নারী গ্রাহকের প্রতিশ্রুতি পূরণের পথ সুগম করবে।
২০২১ সালে মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত করতে বাংলাদেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়নে অংশীদার হতে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী। কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং নাগরিক সমাজের বিকাশের ব্যাপারে সরকারের অঙ্গীকার সংশয়ের মুখে পড়লে বাংলাদেশকে সমর্থন করাটা দুরূহ হয়ে পড়বে বলে মনে করেন হিলারি।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিত করে যুদ্ধাপরাধের বিচারে স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন হিলারি ক্লিনটন। তাঁর মতে, বিচার-প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত হলে তা দীর্ঘদিনের একটি অমীমাংসিত বিষয়ের সুরাহা করবে, সুসংহত হবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র।
সবশেষে ’৯৫ সালে বাংলাদেশ সফরের স্মৃতি উল্লেখ করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিখেছেন, পরিবেশ উন্নততর হলে ভবিষ্যতে তাঁর বাংলাদেশ সফরের পথ সুগম করবে।
মজিনার কণ্ঠে হিলারির সুর: খুব স্বাভাবিকভাবেই হিলারির মতোই বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনাও। ১ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রথম আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে তিনি মন্তব্য করেছেন, হিলারি ক্লিনটনের সফর আয়োজনে তাঁকে আরও কিছু কাজ করতে হবে। পাশাপাশি তিনি এটাও উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনের সময় প্রস্তাবিত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা রূপরেখা চুক্তি (ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট—টিকফা) সই করাটা তাঁর অন্যতম লক্ষ্য।
রূপরেখা বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে মতপার্থক্য: যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রস্তাবিত রূপরেখা বাণিজ্য চুক্তি সইয়ের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা মনে করেন, খসড়া প্রস্তাবনার দু-একটি শর্তের কারণে চুক্তিটি আগামী এক বছরে না-ও হতে পারে। কারণ, শ্রমমান নিয়ে দুই দেশের অবস্থান একেবারে বিপরীতার্থক। যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত মেনে রূপরেখা চুক্তি সই বাংলাদেশের জন্য সমীচীন হবে না। আবার শ্রমমানের বিষয়টিতে চুক্তিতে বাংলাদেশকে ছাড় দিতে রাজি নয় যুক্তরাষ্ট্র।
সরকারের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত সইয়ের জন্য সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের সম্মতিতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় অর্থ, বাণিজ্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে যুক্ত করা হয়। এরই মধ্যে পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে খসড়া চুক্তির শ্রমমানবিষয়ক ধারা সম্পর্কে নেতিবাচক মত প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ ওই দুই মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত শ্রমমানের ধারা মানা উচিত হবে না বলে মত দেয়। আর এ বিষয়ে একাধিকবার দুই মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করেন।
অন্যদিকে সরকারের দায়িত্বশীল এক মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে এ ধারণা দেন যে রূপরেখা বাণিজ্য চুক্তি সই করতে হলে উচ্চপর্যায়ের মার্কিন নেতৃত্বের বাংলাদেশ সফরের আয়োজন করতে হবে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রস্তাবিত বাণিজ্য চুক্তিটি রীতি অনুসারে দুই দেশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা সই করবেন। এতে উচ্চপর্যায়ের কোনো নেতার সই জরুরি নয়।
কূটনীতিকদের অভিমত: ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, দুই দেশের সম্পর্ক গত তিন বছরে যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে হিলারি ক্লিনটনের সফর যে শিগগিরই হচ্ছে না সেটা স্পষ্ট। কারণ, অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিষ্পত্তি না হওয়ার আগেই গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে সরকারের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রকে বিচলিত করেছে। এ নিয়ে সরকারের পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্র সন্তুষ্ট নয়।
ঢাকায় ড্যান ডব্লিউ মজিনার বক্তব্য উল্লেখ করে এক কূটনীতিক বলেছেন, হিলারি যে শিগগিরই আসবেন না, সেটা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কথাতেই স্পষ্ট হয়েছে। ১ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রথম আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে মজিনা বলেছেন, ‘তিনি কখন আসবেন, সেটি এখনো জানি না।’
এ ছাড়া হিলারিকে ঢাকায় আনা মজিনার স্বপ্ন—এ উক্তিটি মনে করিয়ে দিয়ে ওই কূটনীতিক বলেন, বিষয়টি সহজ নয় বলেই তিনি এটিকে তাঁর ‘স্বপ্ন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তা ছাড়া বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূতের মেয়াদকালে রূপরেখা বাণিজ্য চুক্তি সইয়ের বিষয়ে জোর দেওয়া থেকেই স্পষ্ট, এতে দুই পক্ষের মাঝে দূরত্ব দূর করতে সময় দরকার।

No comments

Powered by Blogger.