ইতিহাসে নাম লেখানোর সুযোগ হারালেন সাকিব by উৎপল শুভ্র

জিওফ বয়কট কথাটা খুব বলেন। ব্যাটিংয়ের সময় দল ভালো অবস্থায় থাকলেও সব সময় দুই উইকেট যোগ করে নাও। তুমি আউট হয়ে গেলেই আরেকটি উইকেট পড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের টেস্ট খেলার তীব্রবিরোধী বয়কটের এই টেস্ট ম্যাচ দেখার সম্ভাবনা আর এই শীতে ঢাকায় তুষারপাতের সম্ভাবনা প্রায় সমান। তবে দুর্ঘটনাক্রমে দেখে থাকলে ওই কথাটা উদাহরণসহ বোঝানোর সুযোগ পেয়ে গেছেন সাবেক ইংলিশ ওপেনার।


বাংলাদেশ যে ৫ উইকেটে ৩০৫ থেকে চোখের পলকে ৭ উইকেটে ৩০৫ হয়ে গেল। সেটিও পরপর দুই বলে উইকেট হারিয়ে! পাকিস্তানের বিপক্ষে আগের ১৪টি টেস্ট ইনিংসে নয়বারই দুই শর নিচে অলআউট বাংলাদেশ। তিন শর বেশি স্কোর ছিল একটিই। ২০০৩ সালে পেশোয়ারের সেই ৩৬১-ই সর্বোচ্চ হয়ে রইল। ওই যুগল ধাক্কায় চার শর সম্ভাবনা জাগানো ইনিংস যে ৩৩৮ রানেই শেষ।
তিন শ ছাড়ানো দুটি ইনিংসেই একটা মিল আছে। ধসের মিল। কাল ৩৩ রানে শেষ ৫ উইকেট পড়ল বাংলাদেশের, ৭ রানে শেষ তিন। পেশোয়ারে ধসটা ছিল আরও ভয়াবহ। ৫১ রানে শেষ ৮ উইকেট।
শোয়েব-ঝড়ে উড়ে যাওয়ার পরও পেশোয়ারে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো লিড নেওয়ার স্বাদ মিলেছিল। এখানেও সেই সম্ভাবনা জীবন্তই। পাকিস্তান এখনো ২৫১ রানে পিছিয়ে। ৯ উইকেট বর্তমান। তবে শেষ বিকেলে সাকিব যেভাবে বল টার্ন করালেন, তাতে আজ ব্যাটিং ব্যাপারটা খুব সহজ হবে না। টার্নিং উইকেট আরেকটা স্বস্তিও ছড়িয়ে দিল, শেষে ব্যাটিং করতে হবে পাকিস্তানকেই।
কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে তিন পেসারের কাছে নিশ্চয়ই কিছু চাইবে বাংলাদেশ। নাজমুলের কাছে একটু বেশিই। সাত বছর পর টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম বলেই উইকেট পেয়েছেন। ফেরাটাকে তাৎপর্যপূর্ণ করে রাখার কাজটা ব্যাটিংয়েও করেছেন। এক বল খেলেই রানআউট!
তবে নাজমুল, শাহাদাত ও রবিউলের কেউ নন, তুরুপের তাস সেই সাকিবই। ব্যাটে-বলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের রাজকুমার। টেস্টের প্রথম দিনে সেঞ্চুরি করে সবচেয়ে আলোচিত। দ্বিতীয় দিনেও পাদপ্রদীপের আলো তাঁকে ঘিরেই। এবার অবশ্য বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটির সুবাস পেতে পেতে রানআউট হয়ে যাওয়ায়।
টেস্টে বেশি চালিয়ে খেলার কারণে সমালোচনার কারণেই হোক, অথবা আত্মোপলব্ধি—লম্বা ইনিংস খেলার প্রতিজ্ঞা ফুটে বেরোচ্ছিল সাকিবের সর্বাঙ্গ থেকে। আগের দিন ১৬৮ বলে অপরাজিত ১০৮ রানে চার ছিল ১৪টি। কাল ৭৪ বলে মাত্র ১টি চার। ৩৬ রানের ২৭-ই সিঙ্গেল থেকে। টেস্ট ক্রিকেটে রানআউট এমনিতেই বুকে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এমন একটা ইনিংস রানআউটে শেষ হলে তো আরও বেশি। তার ওপর সেটি যদি টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রথম রানআউট হয়!
আশরাফুলের অপরাজিত ১৫৮ রানের রেকর্ড যখন হাতছোঁয়া দূরত্বে, তখনই ওই সর্বনাশ। মুশফিকুর মিড উইকেটে খেলে সিঙ্গেলের জন্য ডাক দিয়েও ফিরিয়ে দিলেন। এমনই কপাল, তৌফিক উমরের থ্রোটিও সরাসরি স্টাম্পে। সারা দিনে ওই একটিই ডিরেক্ট থ্রো।
অপরাধবোধ থেকেই কি না, কাল সকালে সাকিবের চেয়েও স্বচ্ছন্দ মুশফিকুর রহিম লেগ স্টাম্পের বাইরে গুলের পরের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে বসলেন। বেশির ভাগ রানআউটেই দুই ব্যাটসম্যানের কারও না-কারও দোষ থাকে। যার ‘কল’, তাঁর অপরাধবোধে আক্রান্ত হওয়াটাও স্বাভাবিক। তবে মুশফিকুর তো আর ইচ্ছা করে অমন করেননি। যেমন করেছিলেন ইয়ান বোথাম।
জিওফ বয়কট আসছেন আবারও। কারণ রানআউট নিয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পটা জিওফ বয়কট ও ইয়ান বোথামকে নিয়েই। ‘গল্প’ বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন ঘটনা কল্পকথার মতো শোনায় বলে। বয়কট আত্মজীবনীতে ‘বোথামের দাবি ও আমাকে ইচ্ছা করে রানআউট করেছিল’ বলে প্রসঙ্গটা শেষ করে দিলেও বোথামের বইয়ে সেটির বিস্তারিত বর্ণনা আছে। এখনো সুযোগ পেলেই গর্বভরে তা বলেও বেড়ান।
ঘটনাটা ১৯৭৮ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে। বয়কট আবার সেই টেস্টে অধিনায়ক। দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ডের যখন দ্রুত রান তোলার তাড়া, বয়কট ব্যাটে বলই লাগাতে পারছেন না। সহ-অধিনায়ক বব উইলিস বোথামকে চার নম্বরে প্রমোশন দিলেন, সঙ্গে একটা নির্দেশও, ‘ওটাকে রানআউট করো।’ অসম্ভব একটা সিঙ্গেলের জন্য ‘কল’ করে সেটি করলেনও বোথাম। দলে তুমুল অজনপ্রিয় বয়কট ড্রেসিংরুমে ফিরে অনেকক্ষণ মাথায় তোয়ালে দিয়ে মাথা ঢেকে বসে বিড়বিড় করেছেন, ‘আমি কী করছি? এই শিশুদের সঙ্গে খেলছি?’
সাকিবের এমন কিছু বলার কারণ নেই। তাঁর থাকল শুধু আক্ষেপ। আর মাত্র ১৫টি রানের আক্ষেপ! আশরাফুলের রেকর্ডটি ভাঙতে পারলে যে ক্রিকেট ইতিহাসেই নাম লেখা হয়ে যেত। বাংলাদেশের পক্ষে সেরা বোলিংয়ের (৭/৩৬) রেকর্ডটি তাঁর। দেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ইনিংস ও সেরা বোলিং—দুটি রেকর্ডই নিজের করে নেওয়ার কীর্তি ক্রিকেট ইতিহাসের বিখ্যাত সব অলরাউন্ডারেরও অধরাই থেকে গেছে।
ক্যারিয়ারের শুরুতে সাকিবের পরিচয় ছিল—‘ব্যাটসম্যান, যে বোলিংও করতে পারে।’ ওই ৭/৩৬-এর পর থেকে সেটি বদলে ‘বোলার, যে ব্যাটিংটাও ভালোই পারে।’ গত কিছুদিন ব্যাটিংয়ে ধারাবাহিকতার প্রসঙ্গে সাকিব হেসে বললেন, ‘তার মানে আমি সত্যিকার অলরাউন্ডার হয়ে উঠেছি।’
আসলেই তা-ই। ক্রিকেটে অলরাউন্ড সামর্থ্যের বড় একটা মাপকাঠি ব্যাটিং আর বোলিং-গড়ের পার্থক্য। এই টেস্টের আগে সাকিবের এই দুটি প্রায় সমান (ব্যাটিং-গড় ৩২.৮৮, বোলিং-গড় ৩২.৩৮; পার্থক্য দশমিক পাঁচ)। সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার সোবার্স বোলিংয়ে বৈচিত্র্যের ভান্ডার ছিলেন সত্যি, তবে ব্যাটসম্যান হিসেবে ছিলেন অনেক বেশি ভালো। যে কারণে তাঁর ক্ষেত্রে পার্থক্যটা ২৩.৭৫। আধুনিক ক্রিকেটের সেরা অলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিসের ঘটনাও তা-ই (ব্যাটিং-গড় ২৪.২৭ বেশি)। আশির দশক দাপিয়ে বেড়ানো অলরাউন্ডার চতুষ্টয়ের মধ্যে সাকিবের কাছাকাছি আছেন শুধু কপিল দেব (ব্যাটিং ও বোলিং-গড়ে পার্থক্য ১.৪১)। বাকি তিনজন—রিচার্ড হ্যাডলি (৪.৮৭), বোথাম (৫.১৪) ও ইমরান খানের (১৪.৮৮) দুই ভূমিকায় পার্থক্যটা পরিষ্কার।
এমন সব প্রাতঃস্মরণীয় নাম বলার অর্থ এই নয় যে, সাকিব এখনই তাঁদের পাশে বসে গেছেন। তবে পরিসংখ্যানের উল্লিখিত মানদণ্ডে বাকি সবার চেয়ে এগিয়ে থাকাটা তো আর মিথ্যা নয়। হ্যাঁ, হ্যাঁ, কী বলবেন, জানি! মিথ্যা তিন প্রকার—মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা আর পরিসংখ্যান।
সব সময় বোধ হয় তা নয়!
দ্বিতীয় দিনের শেষে
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ৩৩৮
পাকিস্তান ১ম ইনিংস: ৮৭/১

No comments

Powered by Blogger.