দায়িত্ববোধ-‘সুবল সাহা, আমরা আপনার কাছে ঋণী, চিরঋণী’


ত ১৩ ডিসেম্বরের দৈনিক প্রথম আলোর বিশাল বাংলা পাতায় ছাপা একটি ছোট খবর হয়তো অনেকেরই চোখে পড়েনি। ‘গাড়িচালক বাঁচিয়ে গেলেন ৫২টি প্রাণ’ শিরোনামের খবরের সূত্রে আমরা সবাই পরিচিত হয়েছি সুবল সাহা নামের একজন বাসচালকের সঙ্গে, যিনি মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজ দায়িত্ব পালন করে অর্ধশতাধিক মানুষের জীবন রক্ষা করেছেন। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে বাস চালানো অবস্থায় হূদরোগে আক্রান্ত হন সুবল সাহা, কিন্তু


তা সত্ত্বেও বাসের ব্রেক চেপে ও চোখ লিভার টেনে বাস থামিয়ে একটি অনিবার্য দুর্ঘটনা থেকে সবাইকে রক্ষা করেন।
খবরটি পড়ে অজান্তেই শ্রদ্ধাভক্তি আর অসীম কৃতজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে। একধরনের চাপা কান্নায় অস্থির হয়ে উঠি আমরা। অদ্ভুত এক বিহ্বলতা আমাদের গ্রাস করে। সড়ক দুর্ঘটনার খবর প্রতিদিন পড়তে পড়তে, প্রতিদিন প্রিয়জনদের হারাতে হারাতে আমরা অনেকাংশেই ধরে নিয়েছি যে কেউই হয়তো এখন আর নিজ দায়িত্ব পালন করেন না। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কিংবা প্রশাসনযন্ত্রের অনিয়ম আর দুর্নীতিই যেন শেষ কথা। চালকদের প্রশিক্ষণ নিয়ে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা আর অনিয়মই যখন স্বাভাবিক ঘটনা বলে বিবেচিত হচ্ছে, ঠিক সে সময় সুবল সাহা তাঁর দায়িত্ববোধ দিয়ে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেলেন, এখনো আশা আছে।
সুবল সাহার এই খবর পড়ে প্রথমেই আমাদের মনে হয়েছে এই দায়িত্ববান মানুষটির কথা সবার কাছে বারবার বলা প্রয়োজন। প্রয়োজন তাঁর এই কর্তব্য পালনে নিষ্ঠার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা জানানো। যাঁরা দায়িত্বে অবহেলা করছে—রাষ্ট্রযন্ত্র, আমলাতন্ত্র, প্রশাসন, গাড়িচালক; তাদের সমালোচনার পাশাপাশি এ ধরনের অনুকরণীয় চেষ্টাকে প্রশংসিত করাকেও আমাদের দায়িত্ব বলে মনে হয়েছে। সেই দায়িত্ববোধ থেকে এ নিয়ে কথা বলতেই আমরা কয়েকজন লেখাটি তৈরি করেছি।
কিন্তু কেবল প্রশংসাবাক্যই যথেষ্ট নয়। ১৩ ডিসেম্বরের ওই খবরের একটি অংশে আমাদের চোখ এসে থমকে দাঁড়িয়েছে: ‘স্ত্রী ছাড়াও তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে’। সুবল সাহার মৃত্যু এই পরিবারকে অসহায় অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাই যেন সরকার, বিশেষত যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এই পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করে, সুবল সাহার সন্তানদের শিক্ষা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করে। সরকারের কাছে আবেদনের পাশাপাশি আসুন, আমরাও সবাই মিলে সুবল সাহার পরিবারের পাশে দাঁড়াই। এই পাশে দাঁড়ানো কেবল তাদের বিপদে সহায় হওয়ার জন্যই নয়; একই সঙ্গে সুবল সাহার পরিবার ও সন্তানদের কাছে এই কথা বলার জন্য যে এ দেশে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে নিষ্ঠার মূল্য দেওয়ার মানুষও আছে।
আমাদের সম্মিলিত চেষ্টায় যতটুকু সাহায্যই আমরা করতে পারি না কেন, তার চেয়েও বড় হলো—অন্যান্য ‘দায়িত্বশীল’ চালকের কাছে এ কথা পৌঁছে দেওয়া যে, ‘আমরা সব সময় আপনাদের পাশে আছি, থাকতেও চাই।’ সেই সঙ্গে সুবল সাহার বাসের যাত্রীদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি, ‘সুবল সাহা, আমরা আপনার কাছে ঋণী, চিরঋণী’।
সংযুক্তি: এই লেখার প্রাথমিক খসড়া যখন প্রস্তুত হচ্ছে তখন ফেসবুকের ‘ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবী জনতা’র গ্রুপে সুবল সাহার পরিবারের জন্য সবাইকে আর্থিক সহযোগিতার জন্য আহ্বান জানানো হয়। ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায় বন্ধুদের কাছ থেকে। কয়েকজন বন্ধু প্রবাস থেকে এরই মধ্যে টাকা পাঠিয়েছেন। তাই আসুন, যার যতটুকু সামর্থ্য আছে, তাই দিয়েই আমরা ন্যায়নিষ্ঠ চালক সুবলের পরিবারের পাশে দাঁড়াই।
লেখকেরা: শিক্ষক, সাংবাদিক, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ও উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.