পারমাণবিক ‘ট্রায়াড’, সমুদ্র-ড্রোন, কুকুরসদৃশ রোবট—যত গোপন অস্ত্র দেখাল চীন
সামরিক বিশ্লেষক ও কূটনীতিকদের মতে, প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বুধবারের এ কুচকাওয়াজকে কাজে লাগিয়েছেন বহুমুখী বার্তা পাঠানোর জন্য। একটি বার্তা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের উদ্দেশে, একটি বার্তা দুই প্রতিবেশী ভারত ও রাশিয়ার উদ্দেশে এবং অন্যটি সম্ভাব্য অস্ত্র ক্রেতাদের উদ্দেশে।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক আলেকজান্ডার নিল বলেন, ‘এসব নতুন অস্ত্রের নানা কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও চীন আসলে দেখিয়েছে, তারা প্রযুক্তি ও সামরিক শক্তির সব দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের সামরিক পরিকল্পনাকারীদের জন্য এসব বুঝে ওঠা কঠিন হয়ে পড়বে।’
প্রথমবারের মতো চীন তাদের পূর্ণ পারমাণবিক ‘ট্রায়াড’ বা ত্রিমুখী অস্ত্রশক্তি প্রদর্শন করেছে। এটি স্থল, সমুদ্র ও আকাশ থেকে একযোগে হামলা চালাতে পারে। এর মধ্যে ছিল আধুনিকায়ন করা আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ডিএফ-৫সি, যার পাল্লা ২০ হাজার কিলোমিটার (১২,৪০০ মাইল) আর দীর্ঘপাল্লার নতুন ‘রোড–মোবাইল’ ক্ষেপণাস্ত্র ডিএফ-৬১।
শুধু কৌশলগত স্তরেই নয়, চীন স্পষ্ট করেছে যে তারা নিজস্ব সমুদ্র অঞ্চলেও প্রভাব বিস্তার করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
সিঙ্গাপুরের এস রাজরত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক জেমস চর বলেন, ‘এত বিস্তৃত নতুন অস্ত্রভান্ডার যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের পূর্ব এশিয়ায় যেকোনো সংঘাতের পরিকল্পনা জটিল করে তুলতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘সমুদ্র–ড্রোন আর ক্ষেপণাস্ত্র মিলে এমন এক ঘেরাটোপ তৈরি করতে পারে, যেখানে বাইরের নৌবাহিনী প্রবেশ করতেই পারবে না।’
জেমস চর ও অন্যান্য বিশ্লেষক বলেন, চীন হয়তো ছোট দেশগুলোকে দেখাতে চাইছে যে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক ভূমিকা নিয়ে সংশয়ের মধ্যে তারা এখন ‘শান্তির রক্ষক’ হিসেবে দাঁড়াতে সক্ষম।
বিশেষ করে নতুন টর্পেডো–আকৃতির ড্রোন ও হাইপারসনিক ট্রায়াড অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্রদের জন্য বড় ধরনের হুমকি। এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় চীনের বাড়তে থাকা ডিএফ-২৬ মধ্যমপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, তবে হুমকি আরও বাড়বে। গাইডেড ওয়ারহেড বহনকারী এ ক্ষেপণাস্ত্র মার্কিন জাহাজ ও গুয়ামসহ অন্যান্য ঘাঁটি টার্গেট করতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, তাইওয়ান নিয়ে কোনো সংঘাতে সফল হতে হলে চীনকে দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগরে কার্যত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিন্তু এটি সহজ নয়। কারণ, পূর্ব এশিয়াজুড়ে বহুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বজায় রয়েছে।
তবে সামরিক কুচকাওয়াজে শৃঙ্খলা ও নিখুঁত প্রদর্শনীর আড়ালেও প্রশ্ন থেকেই গেছে এসব নতুন অস্ত্রের পূর্ণ সক্ষমতা ও কার্যকারিতা নিয়ে।
তাইপেভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাসোসিয়েশন অব স্ট্র্যাটেজিক ফোরসাইট’–এর গবেষক চিয়েহ চুং বলেন, ‘চীন বলছে, এসব অস্ত্র কার্যকর অবস্থায় আছে। তবে তা কতটা সত্য, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। অনেক অস্ত্র হয়তো এখনো সীমিতভাবে সেনা ইউনিটে মোতায়েন, পরীক্ষামূলক ব্যবহারের স্তরে রয়েছে এবং স্বাভাবিক উৎপাদনের পর্যায়ে নেই।
চর, নিলসহ অন্য বিশ্লেষকেরা বলেন, চীন দেখিয়েছে যে বিমান প্রতিরক্ষা, যুদ্ধক্ষেত্র ব্যবস্থাপনা ও ড্রোনের সমন্বয়ে তারা উন্নত প্রযুক্তি একত্রে কাজে লাগাতে চাইছে। উদাহরণস্বরূপ, সামরিক কুচকাওয়াজে নতুন যুদ্ধট্যাঙ্ক ‘টাইপ–১০০’ প্রদর্শন করা হয়; যেখানে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও গোয়েন্দা ড্রোনসহ নানা আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করা হয়েছে।
এ ছাড়া নবগঠিত মহাকাশ, সাইবার ও তথ্য–সহায়তা ইউনিটও দেখানো হয়। এসব প্রমাণ করে, চীন উন্নত মহাকাশ যুদ্ধ ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধক্ষেত্রেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে প্রস্তুত।
নিল বলেন, ‘পশ্চিমা সেনারা এখনো কার্যকারিতার দিক থেকে এগিয়ে থাকতে পারে। তবে চীন দ্রুত তাদের ধরে ফেলছে—এটা স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত উন্নয়নাধীন অস্ত্র নিয়ে এত খোলামেলা জানায় না।’
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘আমার মনে হয়, চীনের এসব প্রযুক্তি অন্য দেশকে বিক্রি করার হয়তো একটা ইচ্ছা আছে। আসলে কিছুটা প্রদর্শনী ছিলও এখানে, যেমন দেখা গেছে কুকুরের মতো দেখতে এক রোবট।’ রয়টার্স, সিঙ্গাপুর
অনুবাদ: মো. আবু হুরাইরাহ্
![]() |
| দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে চীনের বেইজিংয়ে আয়োজিত সামরিক কুচকাওয়াজে প্রদর্শন করা অত্যাধুনিক ড্রোন। ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ছবি: রয়টার্স |

No comments