অ্যাটর্নি জেনারেলকে অপসারণ চেষ্টায় অচলাবস্থা, নেতানিয়াহুর সরকার বিপাকে: অস্ট্রেলিয়া-ইসরাইল সম্পর্ক তলানিতে

মানবজমিনঃ ইসরাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল গালি বাহারাভ-মিয়ারাকে অপসারণের প্রক্রিয়া আইনি অচলাবস্থায় থেমে গেছে। ঠিক এমন সময়ে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার প্রকাশ্যে স্বীকার করছে- হুমকি দেয়া ছাড়া তাদের হাতে আর কার্যকর কোনো পথ নেই। এ খবর দিয়ে অনলাইন হারেৎজের রিপোর্ট জানাচ্ছে- সুপ্রিম কোর্ট সরকারের এই প্রচেষ্টাকে অবৈধ বলেছে। তারা বলেছে, অ্যাটর্নি জেনারেলকে অপসারণের প্রচেষ্টা এগিয়ে না নিতে। এর ফলে এক সরকারি সূত্র মন্তব্য করেন, বিচারপতিরা অন্তত আমাদের একদিনের অর্থহীন বিতর্ক থেকে রক্ষা করেছেন। এই অচলাবস্থা সরকারের অবস্থান নরম করেনি, তবে উন্মোচন করেছে ভেতরের বিভাজন ও তীব্র সমালোচনা।

বিশেষ করে ন্যায়বিচার বিষয়ক মন্ত্রী ইয়ারিভ লেভিনের বিরুদ্ধে তা তীব্র হয়েছে। তিনি এ প্রচেষ্টার মূল কারিগর। শাসক জোটের এক জ্যেষ্ঠ সদস্য বলেন, লেভিন অ্যাটর্নি জেনারেলের বিরুদ্ধে হয় ‘সিদ্ধান্তমূলক যুদ্ধ’, নয়তো ‘ক্ষয়িষ্ণু যুদ্ধ’ চালাতে পারতেন। সিদ্ধান্তমূলক যুদ্ধে বেতন বন্ধ করে দেয়া, তার নির্দেশ মানলে প্রসিকিউটর অফিস থেকে লোক বরখাস্ত করা, এমনকি হাইকোর্টকে উপেক্ষা করা হতো। কিন্তু সেই পথ নেয়া হয়নি। ক্ষয়িষ্ণু যুদ্ধে ঢুকে পড়া হলো, আর তাও ঠিকভাবে পরিচালিত হয়নি। তার মতে, একের পর এক ভুল হয়েছে পদ্ধতি বেছে নেয়া থেকে শুরু করে সার্চ কমিটি না ডাকা পর্যন্ত। অন্যদিকে, লেভিনের সমর্থকরা বলছেন, তিনি যা-ই করতেন না কেন, শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টই তা বাতিল করত। একজন সরকারি সূত্র বলেন, যদি লেভিন আইন পরিবর্তন করে অ্যাটর্নি জেনারেলের ক্ষমতা ভাগ করার চেষ্টা করতেন, তাও আদালতে বাতিল হয়ে যেত। তখন আবার বলা হতো, কেন বরখাস্তের চেষ্টা করলেন না? তবে তারা স্বীকার করেন, লেভিন নিখুঁত নন, ভুল করেছেন।

শাসক জোটের আশা- বাহারাভ-মিয়ারা দীর্ঘ স্নায়ুযুদ্ধের ক্লান্তিতে নিজেই অবসর নেবেন, যেমনটা করেছিলেন শিন বেত-এর সাবেক প্রধান রোনেন বার। তবে বাস্তবে সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। বাহারাভ-মিয়ারা ডেমোক্রেসিপন্থি শিবিরে এক প্রতীকী ব্যক্তিত্ব- আইনের শাসনের শেষ প্রহরী হিসেবে বিবেচিত। তাকে অপসারণের পুরো প্রক্রিয়া অনিয়ম আর আইনি লঙ্ঘনে ভরা ছিল। এমনকি সরকারের নীতির প্রতি সহানুভূতিশীল রক্ষণশীল বিচারকরাও এই প্রক্রিয়াকে বৈধতা দিতে পারবেন না।

অস্ট্রেলিয়া-ইসরাইল সম্পর্ক তলানিতে, কিন্তু আড়ালে চলছে সব
২৪শে আগস্ট অস্ট্রেলিয়ার রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে কয়েক হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে গাজায় ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, ফিলিস্তিনিদের সমর্থন জানায় এবং নিজেদের সরকারকে আরও শক্ত অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানায়। এর আগে ৩রা আগস্ট সিডনি হারবার ব্রিজে অনুষ্ঠিত বিশাল সমাবেশ ছিল অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক বিক্ষোভ। সেই বিক্ষোভ সরকারের ওপর চাপ বাড়িয়ে দিয়েছিল। এ সময়ের মধ্যে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। অস্ট্রেলিয়া-ইসরাইল সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ভিসা বাতিল, উভয়পক্ষের কঠোর বক্তব্য, এমনকি ইসরাইলের অস্ট্রেলিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অভিযোগ পর্যন্ত ওঠে। অস্ট্রেলিয়া ও ইসরাইলের সম্পর্ক নিয়ে এক বিশ্লেষণে এসব কথা অনলাইন বিবিসিতে লিখেছেন সাংবাদিক গাভিন বাটলার। তিনি আরও লিখেছেন, এ সপ্তাহে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্স ঘোষণা দিয়েছে- জাতিসংঘ কনভেনশনের আইনি সংজ্ঞা অনুযায়ী ইসরাইল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে। তারা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ত্রাণ খাতে ব্যাপক হামলা এবং প্রায় ৫০ হাজার শিশু নিহত বা আহত হওয়ার তথ্য তুলে ধরে। ইসরাইল এসব অভিযোগকে ‘হামাসের মিথ্যা’ প্রচারণা বলে উড়িয়ে দিয়েছে। এরই মধ্যে জাতিসংঘ সমর্থিত বৈশ্বিক ক্ষুধা পর্যবেক্ষণ সংস্থা নিশ্চিত করেছে গাজায় দুর্ভিক্ষ চলছে। অর্ধ মিলিয়নের বেশি মানুষ ‘ক্ষুধা, নিঃস্বতা ও মৃত্যু’ পরিস্থিতিতে রয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে, ইসরাইল খাদ্য প্রবেশ ‘পদ্ধতিগতভাবে বাধাগ্রস্ত’ করছে।

ক্রমবর্ধমান জনরোষ ও পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ বৃটেন, ফ্রান্স ও কানাডার পথে হেঁটে ঘোষণা দেন- অস্ট্রেলিয়া শর্তসাপেক্ষে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে। তিনি পরে জানান, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে এক টেলিফোন আলাপ তাকে স্পষ্ট করে দেয়, নেতানিয়াহু গাজার মানবিক সংকট নিয়ে ‘অস্বীকারের ভেতরেই’ আছেন। ১৮ই আগস্ট নেতানিয়াহু আলবানিজকে পাঠানো এক চিঠিতে অভিযোগ করেন, এই সিদ্ধান্ত ইহুদি বিরোধী আগুনে ঘি ঢালার সমান এবং হামাসকে তুষ্ট করার নীতি। এরপর থেকে তিনি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কঠোর ভাষায় আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাকে দুর্বল নেতা আখ্যা দিয়ে দাবি করেছেন, অস্ট্রেলিয়ার ইহুদিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টনি বার্ক পাল্টা জবাব দিয়ে বলেছেন, নেতানিয়াহু আসলে ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন।

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষক ইয়ান পারমিটার বলেন, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে কখনো ইসরাইলের এত খারাপ সম্পর্ক আমি দেখিনি। তার মতে, পরিবর্তনের পেছনে মূলত দুটি কারণ কাজ করেছে- নেতানিয়াহুর গাজার মানবিক সংকট অস্বীকার ও গোটা ভূখণ্ড দখলের পরিকল্পনা। আরেকটি বড় কারণ ছিল সিডনি হারবার ব্রিজের ঐতিহাসিক মিছিল, যা জনমতের শক্ত চাপ প্রকাশ করে। ফিলিস্তিনপন্থি আন্দোলনের অনেকেই মনে করেন, সরকার আসলে প্রতীকী পদক্ষেপই নিয়েছে। আড়ালে সামরিক সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রায় অপরিবর্তিত। ইসরাইলের ব্যবহৃত এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের অংশ সরবরাহ করে অস্ট্রেলিয়া। বিশেষ করে বোমা বহনের দরজা খোলার যন্ত্র, যা অন্য কোথাও তৈরি হয় না। যদিও সরকার দাবি করে, এসব প্রাণঘাতী নয়, জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী এটিও অস্ত্র বাণিজ্যের অংশ। এ কারণে আন্দোলনকারীরা সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। সম্প্রতি ইরানের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে অস্ট্রেলিয়া । যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো ঘটল। ইসরাইল এ সিদ্ধান্তকে নিজেদের কূটনৈতিক সাফল্য বলে দাবি করেছে। কূটনৈতিক বিবাদ যতই তীব্র মনে হোক, বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটি স্থায়ী প্রভাব ফেলবে না। মানবসম্পর্ক ও দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক বন্ধনই সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক করে তুলবে।mzamin

No comments

Powered by Blogger.