নতুন ও ক্রমবর্ধমান শক্তিকেন্দ্র গড়ে উঠছে এশিয়ায়, হতে পারে মার্কিন শৃংখলার বিকল্প

চীনের সামরিক শক্তি বুধবার বেইজিংয়ের তিয়ানআনমেন স্কোয়ারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক বিশাল কুচকাওয়াজে পুরোপুরি উন্মোচিত হয়। হাজার মাইল দূরে ওয়াশিংটন ডিসির হোয়াইট হাউসে বসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প তা গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। তিনি বলেন, তারা (চীন) আশা করছিল আমি এটা দেখি, আর আমি দেখছিলামও। যদিও ট্রাম্প চীনের এই মহা-উদযাপন সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলেননি, কেবল একে ‘খুব, খুব চিত্তাকর্ষক’ বলে মন্তব্য করেন। তবে এই কুচকাওয়াজের বার্তাটি বেশ স্পষ্ট। তা হলো একটি নতুন ও ক্রমবর্ধমান শক্তিকেন্দ্র গড়ে উঠছে, যা বিগত শতাব্দীর মার্কিন সমর্থিত বৈশ্বিক শৃঙ্খলার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। বুধবার চীনের বিশাল ওই সামরিক কুচকাওয়াজ নিয়ে অনলাইন বিবিসিতে এভাবেই লিখেছেন সাংবাদিক অ্যান্থনি জারচার। উল্লেখ্য, ওই কুচকাওয়াজে চীন তার সর্বশেষ সামরিক অস্ত্রগুলো প্রদর্শন করেছে। মূলত এর মধ্য দিয়ে তারা বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের সামরিক শক্তিমত্তার প্রকাশ ঘটিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের ওপর যখন অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে বাণিজ্যকে টালমাটাল করে দিয়েছেন, তখন চীন মাথাটাকে আরও উঁচু করে জানান দিচ্ছে তার শক্তি। বিবিসি লিখেছে, ওই দিনই পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট কারোল নাভরোকির সাথে বৈঠকে ট্রাম্প চীনের অনুষ্ঠান নিয়ে খুব কমই আলোকপাত করেন। আগের দিন পডকাস্ট সাক্ষাৎকারে তিনি কুচকাওয়াজকে তুচ্ছ করে বলেন, তিনি ‘চীনের শক্তি প্রদর্শনী নিয়ে উদ্বিগ্ন নন’- যেখানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন এবং আরও দুই ডজন রাষ্ট্রপ্রধান উপস্থিত ছিলেন। তবে মঙ্গলবার রাতেই ট্রাম্প নিজের ট্রুথ সোশ্যালে অভিযোগ করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকার যথাযথ কৃতিত্ব দিচ্ছে না চীন। তিনি লিখেছেন, আমার উষ্ণ শুভেচ্ছা জানাও ভ্লাদিমির পুতিন আর কিম জং উনকে, যেহেতু তোমরা একসাথে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছ।

ট্রাম্প বরাবরই কুচকাওয়াজ ও সামরিক প্রদর্শনীতে আকৃষ্ট হন। তিনি গত মাসে আলাস্কায় পুতিনকে স্বাগত জানান স্টেলথ বোম্বার ফ্লাইওভার দিয়ে। তার প্রথম প্রেসিডেন্সির সময় ফ্রান্সের বাস্তিল দিবসের কুচকাওয়াজে অংশ  নেন এবং সম্প্রতি ওয়াশিংটনে মার্কিন সেনাবাহিনীর ২৫০তম বার্ষিকীতে নিজেও সামরিক কুচকাওয়াজ আয়োজন করেন। তবে বেইজিংয়ের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও নিখুঁত মার্চপাস্টের বিপরীতে ট্রাম্পের অনুষ্ঠান ছিল ইতিহাসনির্ভর- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ট্যাঙ্ক ও স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন পোশাকে সৈন্যরা হোয়াইট হাউসের কাছে কনস্টিটিউশন অ্যাভিনিউ দিয়ে হেঁটে যান। এই বৈপরীত্য ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগানের সাথে মিলে যায়, যেখানে তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর বাণিজ্যনীতি (মার্কেন্টাইলিজম)-এ ফিরে যাওয়াকে আমেরিকার স্বর্ণযুগ বলে মনে করেন।
অ্যান্থনি জারচার আরও লিখেছেন, অন্যদিকে চীনের কুচকাওয়াজ ভবিষ্যতমুখী অস্ত্রশস্ত্রে ভরপুর হলেও এর মধ্যে ইতিহাসও ছিল- বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের বড় ভূমিকার দাবি তুলে ধরা। যদি সেই যুদ্ধ ‘আমেরিকান শতাব্দী’র সূচনা করে থাকে, তবে বেইজিং আশা করছে তাদের ভূমিকাকে সম্মান জানালে ‘চীনা ভবিষ্যৎ’ সহজ হবে।

ট্রাম্প প্রশাসনের সাবেক ভেটেরেনস অ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারি রিচার্ড উইলকি বলেন, এটি মূলত ইতিহাস নতুনভাবে লেখার প্রচেষ্টা। আর আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন নতুনভাবে লেখার প্রথম ধাপই হলো ইতিহাসকে পুনর্লিখন। চীনের কুচকাওয়াজ ছাড়াও এ সপ্তাহে আরও এক দৃশ্য ওয়াশিংটনে উদ্বেগ তৈরি করেছে। সোমবার তিয়ানজিনে অর্থনৈতিক সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বৈঠক হয়। ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে চীন ও ভারতের মধ্যে যে টানাপোড়েন ছিল তা অনেকটাই কমে আসছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বাণিজ্যনীতি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভারসাম্যে নাড়া দিয়েছে। চীন-রাশিয়া-ভারতের নতুন ঘনিষ্ঠতা দেখাচ্ছে যে ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র নতুনভাবে আঁকা হচ্ছে। ট্রাম্পের মতে, শুল্ক আরোপ করা মার্কিন শিল্প রক্ষা ও সরকারকে নতুন রাজস্ব আনার উপায়। কিন্তু কূটনৈতিক মূল্য থাকলেও আপাতত সেটি দিতে তিনি প্রস্তুত।

তবে ঝুঁকি বড়। শুক্রবার এক মার্কিন আপিল আদালত রায় দিয়েছে, ট্রাম্পের বহু শুল্ক আসলে আইনের ভুল ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন তিনি সুপ্রিম কোর্টে যাবেন। যদিও আদালত প্রায়ই তার পক্ষে রায় দেয়, তারা কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া প্রেসিডেন্টের অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগে সতর্ক। তাই জয়ী হবেন তার নিশ্চয়তা নেই। সবশেষে বলা যায়- ট্রাম্প বাণিজ্যে নিজস্ব ছন্দে হাঁটছেন। তিনি আমেরিকাকে নাটকীয়ভাবে নতুন পথে নিয়ে যাচ্ছেন, নতুন আন্তর্জাতিক মিত্রও তৈরি করছেন। তার প্রতিশ্রুতি- এটি দ্বিতীয় এক আমেরিকান স্বর্ণযুগ আনবে। কিন্তু ঝুঁকিও বাস্তব, হোক তা তিয়ানআনমেন স্কোয়ারের কুচকাওয়াজে কিংবা মার্কিন আদালতের ভেতরে।

https://media.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2025-09-03%2Fysld3c6i%2FChina-2.jpg?w=622&auto=format%2Ccompress&fmt=avif

No comments

Powered by Blogger.