আসামে মন্দিরে কারা রেখে গেল গরুর মাংস, এ নিয়ে দুই পক্ষে ঘিরে উত্তেজনা
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, গত রোববার সকালে ধুবড়ি শহরের একটি হনুমান মন্দির চত্বরে পশুর মাংস পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর গত সোমবার সকাল থেকে এলাকায় ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। মন্দির–সংলগ্ন একটি রাস্তা অবরোধ করেন বাসিন্দারা। তাঁরা স্লোগান দেন এবং টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখান।
স্থানীয় প্রশাসন প্রাণীর দেহাবশেষ সরাতে গেলে তাদের বাধা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। বিক্ষোভকারীরা দাবি করেছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত দেহাবশেষ সরাতে দেওয়া হবে না। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, এ নিয়ে তৃতীয়বার ওই মন্দিরে এমন ঘটনা ঘটল। আসাম বিজেপিশাসিত রাজ্য।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। প্রশাসনের ঘোষণা দিয়েছে, ওই এলাকায় সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া ধুবড়ি টাউনে সব দোকানপাট বন্ধ থাকবে। কেবল চিকিৎসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দমকল ও জরুরি পরিষেবা প্রভৃতি খোলা থাকবে। পুলিশ, সেনাবাহিনী, আধা–সামরিক বাহিনী এবং নিরাপত্তাবিষয়ক অন্য সরকারি কর্মকর্তাদের ছাড় দেওয়া হবে।
ভারতের সংবাদমাধ্যম ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’–কে ধুবড়ির জেলা শাসক দিবাকর নাথ বলেছেন, সন্দেহ করা হচ্ছে, স্থানীয় হনুমান মন্দিরের কাছে গরুর দেহাবশেষ পাওয়া যায়। এর জেরে সোমবার থেকে সেখানে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলেও গতকাল রাতে উত্তেজনা অনেকটাই কমে এসেছে। সব সম্প্রদায়কে নিয়ে শান্তি কমিটি গঠন করার পাশাপাশি এলাকায় পুলিশ এবং আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা আজ বুধবার এই বিষয়ে উসকানিমূলক বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘মুসলিমরা গরুর মাংস খায়, হিন্দু এলাকায় ফেলে দেয়, হিন্দুদের তাড়িয়ে দেয়, তারপর জায়গা দখল করে। গরুর মাংসকে একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা আমরা সহ্য করব না। আমরা এটা কখনই হতে দেব না।’
হিমন্তের এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্সে’ প্রকাশ করেছেন আসামের স্বাস্থ্য, পরিবার কল্যাণ এবং সেচ মন্ত্রকের দায়িত্বে থাকা জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী অশোক সিংঘল।
অশোক ঘটনার সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে উত্তেজনায় মদদ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি ধারাবাহিকভাবে ‘এক্সে’ যা লিখছেন, তার বিষয়বস্তু নিয়ে সর্বভারতীয় ও আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যম একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
সিংঘল রোববার থেকে নিয়মিত যা লিখছেন, তার মোটামুটি বিষয়বস্তু হলো—ধুবড়িতে যে ঘটনা ঘটছে, তা হঠাৎ ঘটছে না। তা দীর্ঘদিন ধরে চলা কংগ্রেসের রাজনীতির ফল। এখন মুসলিম সম্প্রদায় গরু খেয়ে তার দেহাবশেষ হিন্দুদের মন্দিরে ফেলছে। সিংঘলের মতে, এর কারণ ধুবড়ির হিন্দু জনসংখ্যা ক্রমশ কমছে।
আসামে কাদের লক্ষ্য করে আদিবাসী, মূল নিবাসীদের আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অনুমতি দিল হিমান্তের সরকার
- ৩০ মে ২০২৫
ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় বিজেপিশাসিত আসাম রাজ্যের মন্ত্রিসভা গত বুধবার একটি প্রস্তাব পাস করেছে। এতে বলা হয়েছে, রাজ্যের আদিবাসী, মূল নিবাসী এবং উপজাতি জনজাতিকে আগ্নেয়াস্ত্র রাখার বিশেষ অনুমতি দেওয়া হবে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার এই ঘোষণাকে ‘বিপজ্জনক পদক্ষেপ’ বলে মন্তব্য করেছেন বিরোধীরা।
মূলত বাংলাদেশি বলে রাজ্যের মুসলিমদের চাপে রাখতে বিজেপি–দলীয় মুখ্যমন্ত্রী হিমান্ত শর্মার সরকার এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে বিশ্লেষকেরা বলছেন।
রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি গৌরব গগৈ গতকাল বৃহস্পতিবার হিমান্ত শর্মার সরকারের এই পদক্ষেপকে ‘বিপজ্জনক’ উল্লেখ করে এর নিন্দা জানান। তিনি বলেন, আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অনুমতি ভবিষ্যতে আসামে সহিংসতা বৃদ্ধি করবে।
বিশ্বশর্মা গত বুধবার মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তকে ‘গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর’ বলে উল্লেখ করে বলেন, ‘আসাম রাজ্যে ধুবড়ি, বরপেটা, নগাঁও, মরিগাঁও, দক্ষিণ শালমারা, গোয়ালপাড়ার মতো এমন অনেক জেলা রয়েছে, যেখানে আমাদের মূল নিবাসী আদিবাসীরা সংখ্যালঘু। তারা নিরাপত্তার অভাবে ভুগছেন। বিশেষত, সম্প্রতি বাংলাদেশের ঘটনার পরে তাঁরা আরও দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তাঁরা মনে করছেন, সীমান্তের ওপার থেকে তাঁদের ওপর হামলা হতে পারে বা তাঁদের গ্রামেও হামলা হতে পারে। এই পরিস্থিতির কথা বিবেচনায় রেখে মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আসামের এসব অঞ্চলে মূল নিবাসী আদিবাসীদের আগ্নেয়াস্ত্রের অনুমতি দেওয়া হবে। আমরা তাঁদের লাইসেন্স দেব।’
হিমন্ত শর্মা যে ছয়টি জেলার কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলোতে মুসলিমদের বসবাস বেশি। যেমন ২০১১ সালের শেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, বরপেটা জেলায় মুসলমান জনসংখ্যা ৭৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ, ধুবড়িতে ৭৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ, নগাঁও জেলায় ৫৬ দশমিক ২০ শতাংশ, মরিগাঁওতে ৫২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, দক্ষিণ শালমারায় ৯৫ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং গোয়ালপাড়া জেলায় ৫৭ দশমিক ৫২ শতাংশ।
এর বাইরেও একাধিক জেলা রয়েছে যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। যেমন পশ্চিম আসামের বঙ্গাইগাঁও, দক্ষিণ আসামে করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি, মধ্য আসামে হোজাই এবং দারাং। তবে সেসব জেলায় আগ্নেয়াস্ত্রের অনুমতি দেওয়া হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
আসাম সরকার অতীত ও বর্তমানের বক্তব্য অনুসারে এসব জেলায় মুসলিমদের মধ্যে প্রধানত রয়েছেন বাঙালি মুসলমান। যদিও মুসলিম সম্প্রদায়ে বড় অংশ এই বক্তব্যকে অস্বীকার করে বলেন, তাঁরা ওই রাজ্যেই জন্মেছেন। তাঁরা বাঙালি নন, আসামের মুসলিম। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছে।
মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রী আরও দাবি করেন, ‘আমরা দেখেছি এখানে উপজাতি সম্প্রদায় চূড়ান্ত ভয়ের মধ্যে রয়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বিশেষত বর্তমানে ‘বাংলাদেশি নাগরিকদের’ ফেরত পাঠানোর যে প্রক্রিয়া চলছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে মূল নিবাসী মানুষের নিরাপত্তাহীনতা আরও বেড়েছে। কিছু কিছু গ্রামে মূল নিবাসী মানুষ চূড়ান্তভাবে সংখ্যালঘু।’
বড়পেটা জেলার উদাহরণ দিয়ে হিমন্ত বিশ্বশর্মা দাবি করেন, ‘বাঘাবার-জনিয়া নামের এক অঞ্চলে কী হচ্ছে, আমি নিজে তা জানি। সেখানকর গ্রামে উপজাতিদের ৫০০টি পরিবার রয়েছে। তাদের আশপাশে আর কেউ নেই। এই অঞ্চল থেকে কেউ আগ্নেয়াস্ত্র রাখার আবেদন জানালে আমরা নিশ্চিতভাবে তাঁকে বন্দুক রাখার অনুমতি দেব।’
কংগ্রেসের বিরোধিতা
আসামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। অনেকেই এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও সমাজের বড় অংশের মানুষ বলেছেন, এর ফলে রাজ্যে ও অঞ্চলে সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
আসামের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সভাপতি গৌরব গগৈ এই সিদ্ধান্তের প্রবল বিরোধিতা করে বলেন, ‘আসামের মানুষের যেটা প্রয়োজন সেটা হলো চাকরি, কম খরচের স্বাস্থ্য পরিষেবা ও শিক্ষা। বন্দুকের প্রয়োজন তাদের নেই। কিন্তু সরকার এখন পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে শক্তিশালী না করে বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রতি সহানুভূতিশীলদের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র বিতরণ করতে চাইছে, যা স্থানীয় অপরাধ চক্রের হাতে পৌঁছাবে। এতে ব্যক্তিগত আক্রোশের ভিত্তিতে বিভিন্ন উপদলের মধ্যে সহিংসতা ও অপরাধ বাড়বে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের হেনস্তা করা হবে।’
গৌরব গগৈ আরও বলেন, এটা সুশাসন নয় বরং অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি পদক্ষেপ, যার ফলে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে এবং জঙ্গলের রাজত্বে তৈরি হবে।
কংগ্রেস নেতা বলেন, এই সিদ্ধান্ত মানুষের কল্যাণে করা হয়নি। নির্বাচন নিয়ে যে উদ্বেগ, তা মাথায় রেখে করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
আসামের পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ভবিষ্যতে সীমান্ত অঞ্চলে বাংলাদেশের সঙ্গে আসাম তথা ভারতের সম্পর্কের আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
![]() |
| আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। ছবি: এএনআই |

No comments