রেইনকোট, খুকরি আর রক্তমাখা ষড়যন্ত্র

ভারতের মেঘালয়ের গিরিখাতে ২রা জুন যে পচাগলা মৃতদেহ উদ্ধার হয়, তা ইন্দোরের বাসিন্দা রাজা রঘুবংশীর। হত্যাকাণ্ডটি এখন এক চাঞ্চল্যকর চুক্তিভিত্তিক খুন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে- যার মূল অভিযুক্ত তার নববিবাহিতা স্ত্রী সোনম রঘুবংশী এবং তার কথিত প্রেমিক রাজ কুশওহা। সোনম স্বামীকে নিয়ে ‘হানিমুন’-এর নাম করে চেরাপুঞ্জি বেড়াতে যান। কিন্তু সেই ভ্রমণের পরিণতি দাঁড়ায় মৃত্যু যাত্রায়। তদন্তে উঠে এসেছে ডিজিটাল প্রমাণ, সিসিটিভি ফুটেজ, রক্তমাখা পোশাক এবং সাক্ষীদের বিবরণ- যেগুলো একেকটি করে খুলে দিয়েছে এক রোমহর্ষক হত্যার পর্দা।

প্রমাণের পাহাড়
তদন্তে যে গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক ও ডিজিটাল প্রমাণ মিলেছে, তা হলো- অভিযুক্ত আকাশের একটি রক্তমাখা শার্ট, ফরেনসিকে নিশ্চিত হয়েছে তাতে যে রক্ত লেগে আছে তা রাজার। সোনমের রেইনকোটেও মিলেছে রক্তের দাগ। হত্যায় ব্যবহৃত ‘খুকরি’ নামের বাঁকা ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযুক্ত আনন্দের পরনে থাকা রক্তমাখা জামাকাপড়। হত্যাযন্ত্র এবং রাজার ব্যবহৃত জিনিসে অভিযুক্তদের আঙুলের ছাপ। অভিযুক্তদের মোবাইল ফোন, ডিজিটাল ডিভাইস। মোট ৪২টি লোকেশনের সিসিটিভি ফুটেজ, যাতে অভিযুক্তদের গতিবিধি ধরা পড়েছে। হোটেল মালিকদের বক্তব্য, যেখানে অভিযুক্তরা নিজেদের আসল নামেই বুকিং দিয়েছিল। স্কুটার ভাড়ার কাগজ, যেখানে নবদম্পতির সই রয়েছে। খুকরি বিক্রেতার সাক্ষ্য। আধার কার্ড ও অন্যান্য পরিচয়পত্রের ফটোকপি, যা অভিযুক্তরা লজে জমা দিয়েছিল। ট্রেন ও ফ্লাইট টিকিট, যা অভিযুক্তদের যাত্রাপথের সঙ্গে মিলে যায়। কল ডিটেইল রেকর্ড: সোনম, রাজ এবং তিন খুনির সক্রিয় যোগাযোগ। মোবাইল লোকেশন ডেটা: হত্যার দিন, ২৩ মে, সকলেই ঘটনাস্থলের আশপাশে। তিন অভিযুক্তের প্রাথমিক স্বীকারোক্তি। অনেক ডিজিটাল প্রমাণ ফরেনসিকে পাঠানো হয়েছে।

যেসব প্রমাণ এখনো অধরা
তদন্তকারীরা এখনো খুঁজে পাননি সোনমের মোবাইল ফোন। তাতে থাকতে পারে ফাঁস হওয়ার মতো চ্যাট, ছবি বা কল লগ। একইসঙ্গে অন্য অভিযুক্তদের মোবাইল ও ঘটনার সময়কার পোশাকও এখনো উদ্ধার হয়নি। আরো একটি বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন রয়েছে রুপির লেনদেন ঘিরে। পুলিশ বলছে, ২০ লক্ষ রুপির বিনিময়ে এই খুন করা হয়েছে। কিন্তু সেই রুপির উৎস ও লেনদেনের পথ এখনো স্পষ্ট নয়।

ঘটনার কালানুক্রম
মে ১১: রাজা ও সোনমের বিয়ে হয় ইন্দোরে।
মে ২১: তাদের শিলং আগমন, বালাজি গেস্ট হাউজে থাকা।
মে ২২: স্কুটার ভাড়া নিয়ে চেরাপুঞ্জির উদ্দেশে রওনা।
মে ২৩: ‘হানিমুন ট্রেক’ শুরু, রাজাকে খুন করা হয়।
মে ২৪: ফেলে যাওয়া স্কুটার উদ্ধার, সোহরারিম এলাকা।
জুন ২: রাজার দেহ উদ্ধার।
জুন ৭: অভিযুক্ত তিন খুনি গ্রেফতার, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশ থেকে।
জুন ৮: সোনম আত্মসমর্পণ করেন উত্তরপ্রদেশের গাজিপুরের নন্দগঞ্জ থানায়।

খুনের ছক ও ঘটনার পুনর্গঠন
সোনম ও রাজের সম্পর্ক: রাজা কিছুই জানতেন না। রাজ ছিলেন সোনমের পারিবারিক ব্যবসায় কর্মরত। তিন খুনি (আকাশ, আনন্দ, বিকাশ) ইন্দোর থেকে শিলং পৌঁছান বিভিন্ন যানবাহনে চেপে, যাতে কারো নজরে না আসেন।
মে ২৩: চেরাপুঞ্জির কম চেনা মাওলিংখিয়াত ট্রেইল দিয়ে ট্রেক শুরু করেন পাঁচজন।
১০টা নাগাদ: স্থানীয় গাইড আলবার্ট দেখেন যে তারা গাইড নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
ট্রেইলে একান্তে যাওয়ার পর: সোনম পিছিয়ে পড়েন এবং চিৎকার করেন ‘মেরে দো!’
তারপর: বিকাশ প্রথম আঘাত করে, বাকিরা মিলে রাজাকে মাথা ও বুকে কোপায়।
দেহ গিরিখাতে ফেলে দেওয়া হয়: যেখানে সোনম নিজেও সহায়তা করেন বলে অভিযোগ।

পলায়নের রাস্তায়
খুনের পর সোনম মাওকাডক থেকে ট্যাক্সিতে শিলং যান। এরপর গুয়াহাটি হয়ে ট্রেনে ইন্দোর ফেরেন বলে অনুমান। তিন খুনি আলাদা আলাদা ট্রেনে করে গিয়েছেন মধ্যপ্রদেশ।

কীভাবে ফাঁস হলো ষড়যন্ত্র
প্রথমে সোনম নিজেকে নিখোঁজ দেখানোর চেষ্টা করেন, যেন মনে হয় তিনিও অপহৃত। কিন্তু পরবর্তীতে ৮ জুন গাজিপুরে আত্মসমর্পণ করেন। তদন্তে নেতৃত্ব দেন মেঘালয় পুলিশের এসপি বিবেক সিয়েম। তার ভাষায়, উল্লেখযোগ্য ডিজিটাল, ফরেনসিক ও সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে সোনম ও রাজ কুশওহার বিরুদ্ধে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.