আসামের নাগরিক তালিকায় বাদ পড়াদের সামনে কঠিন আর জটিল পথ by অনিম আরাফাত

গত শনিবার ভারতের আসাম রাজ্যে জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এতে ৩ কোটি ১১ লাখ মানুষ ঠাঁই পেলেও তালিকা থেকে বাদ গেছেন ১৯ লাখেরও বেশি মানুষ। কার্যত এই বিশাল সংখ্যক মানুষ এখন রাষ্ট্রহীন হওয়ার পথে। যদিও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছে, সব আইনি বিকল্প সমপন্ন না হওয়া   পর্যন্ত কাউকেই বিদেশি হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে না। তবে তালিকা প্রকাশের পর এখন এই ১৯ লাখ মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা নিজেরাই অন্ধকারে আছেন। হতাশ হয়ে পড়ছেন প্রায় সবাই। এক ধরনের চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে আসামের বাংলাভাষীদের মধ্যে।
নিয়ম অনুযায়ী যাদের নাম চূড়ান্ত তালিকায় আসেনি তাদের মোট ৪ মাস বা ১২০ দিন সময় দেয়া হবে নিজেকে ভারতীয় নাগরিক প্রমাণের জন্য। এর আগে এই সময় ৬০ দিন ছিল।
ভারতীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যাদের নাম এই চূড়ান্ত তালিকায় আসেনি তাদের যুক্তি শোনা হবে। পর্যায়ক্রমে এ জন্য ১ হাজার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে আসামজুড়ে। ইতিমধ্যে ১০০ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে এবং সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেই আরো ২০০ গঠন করা হবে। তবে সেখানেও যদি কেউ হেরে যায় তাহলেও হতাশ হওয়ার কিছু নেই। তারা চাইলে আদালতে ও এরপর সুপ্রিম কোর্টে মামলা করতে পারবেন।
কিন্তু এতে আশান্বিত হতে পারছেন না বাদ পড়া নাগরিকরা। নিজেদের ভারতীয় প্রমাণ করতে তাদের পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ ও অনিশ্চিত আইনি পথ। এই দীর্ঘ, জটিল ও ব্যয়বহুল পদ্ধতিতে কতজন নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারবেন সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ধারণা করা হচ্ছে পুরো প্রক্রিয়ার জন্য খরচ হবে আনুমানিক ৪০ হাজার ভারতীয় রুপি। সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত মামলা গড়ালে এ খরচ আরো বৃদ্ধি পাবে। তালিকায় নাম না আসা অনেকেই বলেছেন তাদের কাছে প্রয়োজনীয় সকল ডকুমেন্টস আছে। ট্রাইব্যুনালে গিয়ে নিজেদের তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে তারা আত্মবিশ্বাসী বলেও জানিয়েছেন।
তবে ট্রাইব্যুনাল যেভাবে কাজ করে তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা বিতর্ক। বলা হচ্ছে, সেখানে গিয়ে সুবিচার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। তাদের থেকে ইচ্ছেমতো সাক্ষ্য আদায় করে নেয়া হচ্ছে। বাদ পড়া মানুষদের বেশির ভাগ গরিব হওয়ায় ছোটখাটো ধমকিতেই ঘাবড়ে যান তারা। ফলে তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে তা সরকারকেই নির্ধারণ করতে হবে। এ ছাড়া যে আপিল আবেদনের সুযোগ রাখা হয়েছে তাতেও খুব বেশি সুবিধা পাবেন না এইসব মানুষ। সরকার বলছে, তাদের পর্যাপ্ত আইনি সমর্থন দেয়া হবে। কিন্তু দিনশেষে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের কাজটি তাকেই করতে হবে। এই পুরো বিষয়টি এই সংকটকে জটিল করে তুলতে পারে। কারণ, সেখানে নাম, বয়স বা ঠিকানার ছোটখাটো ভুলেও কারো আবেদন বাতিল হয়ে যেতে পারে। আবার দুইজনের সামান্য পরসপরবিরোধী বক্তব্যও কারো নাগরিকত্ব প্রমাণের পথে বাধা হতে পারে। তাছাড়া বাদ পড়া অনেকে জানেনই না কীভাবে এই জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। খোদ গুয়াহাটিতেই অনেকে ট্রাইব্যুনালে আবেদনের বিষয়ে অন্ধকারে আছেন।
ধারণা করা হচ্ছে একদম শেষ পর্যায়ে গিয়ে বাদ পড়া এই মানুষের সংখ্যা কমে আসবে। অনেক পরিবারেই দেখা গেছে, বাবা-মা’র নাম এলেও সন্তানের নাম আসেনি। এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যারা নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হবেন তাদের পরিণতি কী হবে তা এখনো কেউ সপষ্ট করে বলছে না। আগামী ১২০ দিনের মধ্যে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হলে তাদের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে হতে পারে। যাদের নাম বাদ পড়েছে তাদের বেশির ভাগই দরিদ্র মুসলিম বাংলাভাষী। তাদেরকে বিদেশি ঘোষণার পর বাংলাদেশে পাঠানো ভারতের জন্য কঠিন হবে। তাই ধারণা করা হচ্ছে, তখন হয়তো তাদের বিতাড়িত না করে বন্দিশিবিরে রাখা হবে। মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি হয়তো কাজ করার সুযোগ পাবেন। কিন্তু নাগরিকত্ব না থাকায় তারা কোনো নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন না। এ ছাড়া তাদের বর্তমানে যে সমপদ আছে সেটির দখল নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠছে। সব মিলিয়ে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন আসামের লাখ লাখ মানুষ।

No comments

Powered by Blogger.