ভারতের রোহিঙ্গা মুহূর্ত: মোদি’র হিন্দুত্ববাদী শক্তির খেলায় হুমকির মুখে আসামের লাখ লাখ অধিবাসী by দেবাশীষ রায় চৌধুরী

১৯৬২ সালের শীতকালে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের জনগণকে আতঙ্ক গ্রাস করেছিলো। রণভঙ্গ দিয়ে পালাতে থাকা ভারতীয় বাহিনীর পিছে ধাওয়া করে চীনের সেনারা আসামের চলে আসার উপক্রম হয়। চীনারা এসে পড়ছে এই ভয়ে সরকারি অফিসাররা সব কাগজপত্র পুড়িয়ে পলিয়ে যাচ্ছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ায় লোকজনও পালাতে শুরু করে। আতংকে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকে থাকা নোট পোড়ানো শুরু হয় এবং কারাগার থেকে মানসিক সমস্যাগ্রস্ত বন্দীদের ছেড়ে দেয়া হয়। স্থানীয়রা দেখে যে কয়েদীরা চীনের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছে। এতে তারা মনে করে চীনারা তাদের ছেড়ে দিয়েছে।

২০ নভেম্বর রেডিও ভাষণে তৎকালীণ প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু জাতিকে পরাজয়ের কথা জানাতে গিয়ে বলেন যে তার হৃদয় আসামের জনগণের সঙ্গে রয়েছে। নয়া দিল্লি আসামকে পরিত্যাগ করবে বলে কোন লক্ষণ দেখা না গেলেও আসামবাসী মনে মনে সেই ধারণা করে নিয়েছিলো। কিন্তু বেইজিং হঠাৎ করে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে সেনাদের ফিরিয়ে নেয়। এক মাস আগে হঠাৎ করে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো তা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়। আসাম ভারতের অংশ হিসেবে থেকে যায়।

কিন্তু সুরো দেবীর সংগ্রাম তখন শুরু হয়।

যুদ্ধের শেষ দিকে আসামের রাজধানী গৌহাটিতে মুক্তি দেবী নামের এক বস্তিবাসী রাস্তার পাশে এক মেয়ে নবজাতক কুড়িয়ে পায়। সে তাকে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করে। তার নাম রাখে সুরো। একসময় কামিনি সিংহ নামে এক স্থানীয় ছুতারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের একটি মেয়েও হয়। কিন্তু মেয়ের বয়স পাঁচ বছরের সময় কামিনি মারা যায়। ফলে মেয়েকে নিয়ে অথৈ পানিতে পরে সুরো। অন্যের বাসায় কাজ করে জীবন চলে সুরোর।

সে সময় বিখ্যাত ইতিহাসবিদ অমলেন্দ গুহ শিক্ষাদানের কাজে দেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরে আসামে ফিরে এসেছেন। সুরো তার বাসায় কাজ পায়। গুহ মারা গেলে তার স্ত্রী আমিয়া’র দেখভালের সব দায়িত্ব সুরোর উপর বর্তায়। দিন কোনমতে কেটেই যাচ্ছিল। কিন্তু আবার সুরো প্রতি বাঁকা হাসি হাসে জীবন। সে একটি বসতভিটা পেলেও জন্মভূমি পাওয়া ভিন্ন বিষয়।

৫৯ বছরের জীবনে কখনো গৌহাটির বাইরে যায়নি যে সুরো সে এখন অবৈধ অভিবাসী হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। আসাম তার বৈধ নাগরিকদের তালিকা তৈরি করছে। এই তালিকায় রাজ্যটির ৪.১ মিলিয়ন মানুষ এখন পর্যন্ত স্থান পাবে কিনা নিশ্চিত নয়। ৩১ আগস্ট চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর সুরো জানতে পারবে আবারো সে পরিত্যক্ত হয়েছে কিনা, এবারা রাষ্ট্র দ্বারা।

বিশাল কর্মযজ্ঞ

ভারতের মধ্যে একমাত্র রাজ্য আসাতে ১৯৫১ সালে একটি নাগরিক তালিকা (এনআরসি-ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন) তৈরি হয়। অবৈধ অভিবাসীদের আলাদা করার জন্য এই তালিকা। নবসৃষ্ট পাকিস্তান থেকে আসা অভিবাসীদের আলাদা করার জন্য তালিকাটি তৈরি করা হয়। গত বছর ৩০ জুলাই এনআরসি’র খসড়া প্রকাশ করা হয়। এতে রাজ্যের নাগরিকদের মধ্যে ৪ মিলিয়নের বেশি নাম বাদ পড়ে। গত জুনে আরো এক লাখ মানুষের নাম বাদ দেয়া হয়। ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় আসামের জনসংখ্যা ৩৫ মিলিয়ন।

বাদ পড়া নিয়ে আবেদনকারী ৩.১ মিলিয়ন মানুষের নাম যাচাই-বাচাইয়ের পর চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশ করা হচ্ছে। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর কত মানুষ বাদ পড়বে তা এখনো কেউ জানে না। আগে প্রকাশিত দুটি তালিকা থেকে অনুমান করা যায় এতদিন নিজের দেশ হিসেবে জেনে আসা দেশটিতে লাখ লাখ মানুষ দেশহীন হয়ে পড়বে। নিকট অতীতে এত বিপুল সংখ্যক রাজ্যহীন মানুষ দেখা যায় শুধু মিয়ানমারের রাখাইনে – রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেখানে বাস করলেও মিয়ানমার সরকার ১৯৮২ সালের সংবিধানে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দিয়েছে। দুই বছর আগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণহত্যা  চালায় দেশটির সেনাবাহিনী। যার জের ধরে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশের উদ্বাস্তু শিবিরগুলোর আশ্রয়ে।

আগামী সপ্তাহে যখন আসামে নাগরিক তালিকা প্রকাশিত হবে তখন সেখানেও একই ধরনের সহিংসতা ও অশান্তি শুরু হবে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
এনআরসি তালিকায় নাম আছে কিনা তা দেখার জন্য আসামবাসীর লাইন, ছবি: এএফপি

No comments

Powered by Blogger.