কাশ্মিরে দুর্বৃত্তের আচরণ করছে মোদি সরকার: অরুন্ধতী রায়

জম্মু-কাশ্মিরকে সুবিশাল বন্দিশিবিরে রূপান্তর করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বনামধন্য ভারতীয় বুদ্ধিজীবী অরুন্ধতী রায়। কাশ্মিরিদের সঙ্গে মোদি সরকার দুর্বৃত্তের আচরণ করছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। ভারতের স্বাধীনতা দিবসে মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ লেখা নিবন্ধে বুকারজয়ী এই উপন্যাসিক দাবি করেছেন, কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন ক্ষুণ্ন করে কুরুচিপূর্ণ পন্থায় তা উদযাপন করছে ভারত।
গত ৫ আগস্ট ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের ঘোষণার মধ্য দিয়ে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। জম্মু-কাশ্মিরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করতে পার্লামেন্টে পাস হয় একটি বিলও। আর গত ৯ আগস্ট রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে আইনে পরিণত হয় তা। এই পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে কাশ্মিরজুড়ে মোতায়েন করা হয়েছে বিপুলসংখ্যক অতিরিক্ত সেনা। ইন্টারনেট-মোবাইল পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে সেখানকার বিপুলসংখ্যক স্বাধীনতাপন্থী ও ভারতপন্থী রাজনৈতিক নেতাকে।
১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে ‘নীরবতাই সবথেকে জোরালো আওয়াজ’ (The Silence Is the Loudest Sound) শিরোনামের নিবন্ধে অরুন্ধতী রায় লিখেছেন, ভারত যখন ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের ৭৩ তম বর্ষপূর্তি উদযাপন করছে, তখন ছিন্নমূল শিশুরা দিল্লির রাস্তায় থমকে থাকা যানবাহনের পাশে গিয়ে গিয়ে বড় মাপের জাতীয় পতাকা ও স্যুভেনির বিক্রি করছে। সেগুলোতে লেখা ‘মেরা ভারত মহান হে’ (আমার ভারত মহান)। সত্যিকার অর্থে ‘আমার ভারত মহান’-এ কথাটা এ মুহূর্তে অনুভব করতে পারা কঠিন। কারণ আমাদের সরকারের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে তারা যেন দুর্বৃত্তে পরিণত হয়েছে।’
ভারতের সংবিধানে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসনের যে নিশ্চয়তা ছিল, মোদি সরকার ৩৭০ ধারা বাতিল করার পর এর অন্তর্গত ৩৫-এ অনুচ্ছেদে বর্ণিত কাশ্মিরিদের বিশেষ সুবিধাও বাতিল হয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ‘৩৫-এ’ অনুযায়ী কাশ্মিরের বাসিন্দা নন এমন ভারতীয়দের সেখানে সম্পদের মালিক হওয়া ও চাকরি পাওয়ায় বাধা ছিল। সরকারের সিদ্ধান্তে সেই বাধা দূর হয়েছে। এখন চাইলেই যে কোনও ভারতীয় নাগরিক সেখান ভূমিসহ অন্যান্য সম্পদ কিনতে সক্ষম হবে।
নিবন্ধে অরুন্ধতী লিখেছেন, “ব্রিটিশ প্রথা অনুযায়ী টেবিল চাপড়ে আইনটি পাস হওয়াকে স্বাগত জানিয়েছে ভারতের পার্লামেন্ট। রাজ্যটির আইনি স্বীকৃতি বাতিল করার অর্থ হলো অনুচ্ছেদ ৩৫ (এ)ও বিলুপ্ত করা; এর আওতায় এতোদিন কাশ্মিরি বাসিন্দাদের অধিকারের স্বীকৃতি ছিল এবং নিজেদের এলাকার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই ছিল। সুতরাং ‘ব্যবসায়ের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে’ এ কথাটির মানে স্পষ্ট করতে হবে। এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে ইসরায়েলি ধাঁচের বসতি স্থাপন ও তিব্বতের ধাঁচে জনসংখ্যা স্থানান্তরের মতো বিষয়গুলোও।”
স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে কাশ্মিরকে দুটি আলাদা অঞ্চলে ভাগ করার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত ৮ আগস্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। রেডিও,টেলিভিশনে এক যোগে সম্প্রচারিত ভাষণে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তকে ঐতিহাসিক আখ্যা দেন তিনি। বলেন, সংবিধানের ৩৭০ ধারা কাশ্মিরি জনগণকে স্বজনপ্রীতি,সন্ত্রাসবাদ ও বিভক্তি ছাড়া কিছুই দেয়নি। সংবিধানের ওই ধারা বাতিলের মধ্য দিয়ে কাশ্মির ও ভারতীয় জনগণের নতুন যুগের শুরু হবে বলে দাবি করেন মোদি। কাশ্মিরের পণ্য বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে যাবে বলেও দাবি করেন তিনি।
গত ৮ আগস্টের (এবারের অচলাবস্থার চতুর্থ দিন) কথা স্মরণ করে অরুন্ধতী লিখেছেন, ‘এদিন নরেন্দ্র মোদি মূলত উদযাপনমুখর ভারত ও অবরুদ্ধ কাশ্মির নিয়ে টেলিভিশনে ভাষণ দিয়েছিলেন। বক্তব্যে তিনি বুঝিয়েছিলেন কিভাবে কাশ্মিরে আবারও বলিউড চলচ্চিত্রের শ্যুটিং করা যাবে।
ইন্টারনেট দুনিয়ায় বিভিন্ন নারী-বিদ্বেষী বক্তব্য এবং ‘কাশ্মির থেকে ভারতীয়রা এখন মেয়ে এনে বিয়ে করতে পারবে’-হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খাট্টারের এমন বিতর্কিত মন্তব্যসহ নানা কুরুচিপূর্ণ উপায়ে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন বাতিলের ঘোষণা উদযাপন করেছে ভারত। অরুন্ধতী মনে করেন, এসবের মধ্যেও সবচেয়ে বড় আওয়াজটি হলো কাশ্মিরে টহলকৃত ও ব্যারিকেডে ঘেরা রাস্তা এবং সেখানকার  অবরুদ্ধ, নির্যাতিত, কাঁটাতারে ঘেরা, ড্রোনের নজরদারিতে থাকা এবং পুরোপুরি যোগাযোগব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে বসবাসকারী প্রায় ৭০ লাখ কাশ্মিরির নিথর নীরবতা।

No comments

Powered by Blogger.