নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি-১- ওসমান পরিবারের রাজনীতি সংকটে by রাজীব নূর ও আসিফ হোসেন

নারায়ণগঞ্জের যে পরিবারটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগের জন্মের ইতিহাস, সেই খান সাহেব ওসমান আলীর পরিবারের রাজনীতি তৃতীয় প্রজন্মে এসে এখন টালমাটাল।
 
আলামত বলছে, চতুর্থ প্রজন্মে কেবল ভরাডুবিই অপেক্ষা করছে। এই দুই প্রজন্মের কাণ্ডকীর্তিতে ওসমান পরিবারের ঐতিহ্যের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও টান পড়েছে।গত মাসের শেষ দুই সপ্তাহে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এই চিত্র পাওয়া গেছে। Untitled-23 
তাঁদের অধিকাংশ মনে করেন, নানা অপকর্মের কারণে রাজনৈতিকভাবে ওসমান পরিবারের মৃত্যু এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে এই পরিবারের পক্ষে শামীম ওসমানের দাবি, ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে তাঁর পরিবার।ওসমান পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মে ছিলেন ওসমান আলীর দুই ছেলে শামসুজ্জোহা ও মোস্তফা সরোয়ার। তৃতীয় প্রজন্ম শামসুজ্জোহার তিন ছেলে—নাসিম ওসমান, সেলিম ওসমান ও শামীম ওসমান। চতুর্থ প্রজন্ম নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমান এবং শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমান।
সংকটে ওসমানেরা: আওয়ামী লীগের নারায়ণগঞ্জ শহর শাখার সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘একদা ওসমান পরিবার আওয়ামী লীগকে কিছু দিয়েছিল এবং আওয়ামী লীগও ওই পরিবারকে কম দেয়নি। বিনিময়ে এখন তারা আওয়ামী লীগকে দিয়েছে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজের তকমা।’ তাঁর বিশ্বাস, নারায়ণগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ যে ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে মুখ খুলছে, ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছে, তা আওয়ামী লীগের নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিকে নিষ্কলুষ করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।প্রবীণ সাংবাদিক অহিদুল হক খান বলেন, ‘ওসমান পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম নাসিম, সেলিম ও শামীম ওসমানকে নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু নাসিমের ছেলে আজমেরী ও শামীমের ছেলে অয়নের কাণ্ডকীর্তি সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। সর্বশেষ মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের পর সন্দেহের তিরে বিদ্ধ হচ্ছেন আজমেরী ও অয়ন ওসমান।’ওসমান পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর-বন্দর) আসনের জাতীয় পার্টির (জাপা) সাংসদ নাসিম গত ২০ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় বলেছেন, ‘নারায়ণগঞ্জে আমরাই থাকব। এখানে অন্য কোনো খেলোয়াড় আমাদের সঙ্গে খেলে টিকবে না। অতীতে আমাদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে নাজমা রহমান, গিয়াসউদ্দিন ও হাফেজ মুক্তার নারায়ণগঞ্জ থেকে বিদায় হয়ে গেছে।’ ওই দিন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ওই সভায় কমিটির সদস্য ও আওয়ামী লীগের জেলা শাখার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মো. শহীদুল্লাহর বক্তব্যের জবাবে নাসিম এসব কথা বলেন। শহীদুল্লাহ ৭ আগস্ট শহরের কলেজ রোডে নাসিমের ছেলে আজমেরীর একটি ‘টর্চার সেলে’ র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) পরিচালিত অভিযানে ‘রক্তমাখা প্যান্ট, নির্যাতনে ব্যবহূত লাঠি ও রশি’ উদ্ধারের বিষয় উল্লেখ করে সভায় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে ওসমান পরিবার সন্ত্রাস, খুন ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করে চলছে। এইবিবরণ পরের দিন বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।
ঢাকায় ৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে শামীম ওসমানের মুখোমুখি হলে তিনি অতীতে বহুবার আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে ওসমান পরিবারকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র হয়েছে বলে দাবি করেন। তারপর বলেছেন, শেষ পর্যন্ত তাঁরাই টিকে থেকেছেন।
আজমেরীর টর্চার সেলে র‌্যাবের অভিযান ও বিভিন্ন আলামত উদ্ধার সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে শামীম ওসমান বলেন, ‘ওখানে কী পাওয়া গেছে? লাঠি তো সবার ঘরে রাখা হয়। প্যান্টটিতে যে রক্তমাখা আছে, তা ফরেনসিক টেস্ট ছাড়া বলা হলো কী করে?’ তিনি বলেন, এসব ঠুনকো ষড়যন্ত্র করে নারায়ণগঞ্জ থেকে খান সাহেব ওসমান আলীর পরিবারকে বিতাড়িত করা যাবে না।
ওসমান পরিবারের ইতিহাস: খান সাহেব ওসমান আলী নারায়ণগঞ্জে এসেছিলেন ব্যবসা করতে। তাঁর পৈতৃক নিবাস কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দির জামালকান্দি গ্রামে। তিনি নারায়ণগঞ্জে আসেন গত শতাব্দীর বিশের দশকের গোড়ার দিকে। পাটের ব্যবসা করে প্রভূত উন্নতি করেন এবং ১৯৩৫ সালে চাষাঢ়া রেললাইন-সংলগ্ন এলাকায় বায়তুল আমান নামে একটি বাসভবন তৈরি করেন।
শামীম ওসমান বরাবরই দাবি করে আসছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পদচারণে সিক্ত এ ভবনটিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের। নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী অবশ্য প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে অবশ্য ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। তিনি আত্মজীবনীর ১০১ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ার একটি ক্লাবে তাঁরা প্রথম সভা করেছিলেন।
এ বিষয়ে শামীম ওসমান বলেন, ‘ওই ১০১ নম্বর পৃষ্ঠাতেই সভার অন্যতম আয়োজক হিসেবে আমার বাবা শামসুজ্জোহার নাম এবং তিনি যে ওই দিন মুসলিম লীগের গুন্ডাদের হাতে আহত হয়েছিলেন তা লেখা আছে। সভাটি বায়তুল আমানেই হওয়ার কথা ছিল, ১৪৪ ধারা জারি হওয়ার কারণে স্থান পরিবর্তন করা হয়েছিল।’
‘এসব কূটতর্ক এতকাল পরে কেন তোলা হচ্ছে’ সে প্রশ্ন তুলে শামীম ওসমান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীর ১৬৫ পৃষ্ঠায় স্পষ্ট করে লিখেছেন “খান সাহেবের বাড়ি ছিল আমাদের আস্তানা”। এই খান সাহেবটি আমার দাদা খান সাহেব ওসমান আলী।’
১৯৭১ সালে খান সাহেব মারা যান। অবশ্য তাঁর মৃত্যুর আগেই সত্তরের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে রাজনীতির পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি শামসুজ্জোহা। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালেও সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৮৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মারা যান শামসুজ্জোহা।
ওসমানেরা তিন ভাই: নাসিম, সেলিম ও শামীম—ওসমানদের তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট শামীম ওসমান। তবে আলোচনায় সব সময়ই তিনি সবার আগে। আশির দশকের শুরুর দিকে তোলারাম কলেজে ছাত্রলীগ দিয়ে শামীমের রাজনীতি শুরু। ১৯৮১ সালেই তিনি ওই কলেজের সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে তিনি আওয়ামী লীগের নারায়ণগঞ্জ শহর ও জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শামীম সাংসদ হওয়ার পর থেকে ওসমান পরিবারের নেতিবাচক ভাবমূর্তি প্রকট হতে শুরু করে।
এলাকাবাসী বলেন, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের নির্বাচন পর্যন্ত শামীমই ছিলেন নারায়ণগঞ্জের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির গিয়াসউদ্দিনের কাছে পরাজিত হয়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে যান তিনি। ২০০৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জে ফিরেন। কিন্তু এক-এগারোর জরুরি অবস্থা জারি হলে আবারও পালাতে হয় তাঁকে। পরে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের হয়ে বিজয়ী হন চলচ্চিত্রাভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী।
শামসুজ্জোহার জীবদ্দশাতেই তাঁর বড় ছেলে নাসিম এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে সাংসদ হন। সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো সাংসদ হয়েছেন তিনি।
মেজো ভাই সেলিম ওসমান ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত শামীম ওসমান সাংসদ থাকাকালে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নারায়ণগঞ্জ চেম্বারের সভাপতি হয়েছেন। এবারও শামীম দেশে ফেরার পর তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নারায়ণগঞ্জ চেম্বারের সভাপতি হন। দুই দফা নারায়ণগঞ্জ ক্লাবেরও সভাপতি হয়েছিলেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) নির্বাচনেও সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। ২০০২ সালে সেনাবাহিনী সেলিম ওসমানকে অবৈধ অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেলিমের বিরুদ্ধে দায়ের করা অস্ত্র মামলাটিকে রাজনৈতিক অভিহিত করে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে র‌্যাবের কার্যালয়ের নোটিশ বোর্ডে শীর্ষ অপরাধী হিসেবে শামীম ওসমানের ছবি টাঙানো ছিল। ওই বোর্ডে দ্বিতীয় শীর্ষ অপরাধী হিসেবে ছিল তাঁরই বড় ভাই নাসিমের ছেলে আজমেরী ছবি। নারায়ণগঞ্জ পুলিশের তালিকায়ও শামীম ওসমান ছিলেন ‘এক নম্বর সন্ত্রাসী’।
জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের ওয়েবসাইটে ছবিসহ শামীম ওসমানকে ধরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা ছিল। তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলে রেড নোটিশ পাঠানো হয়েছিল তখন। পলাতক থাকা অবস্থায় শামীমের বিরুদ্ধে সাত বছরের সাজাও হয়েছিল।
এখন আর ওই সব তালিকায় শামীম ওসমান বা আজমেরীর নাম নেই। ইন্টারপোলের নোটিশের কার্যকারিতা শেষ। তবে আছে ওসমান পরিবারবিরোধী গণ-আন্দোলন। এ আন্দোলনে পুরোধার ভূমিকায় চলে এসেছেন নিহত ত্বকীর বাবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন ওসমান পরিবারের দৌরাত্ম্যে জনগণ মুখ খুলতে সাহস করে না। এবারই প্রথম ব্যতিক্রম ঘটল। মুখ খুলছে মানুষ।

No comments

Powered by Blogger.