ক্লার্ককে ক্ষমা করেননি ক্যাটিচ by আরিফুল ইসলাম

নীরবতা সম্মতির লক্ষণ, কখনো কখনো নীরব হাসিও। সাইমন ক্যাটিচ যেমন দেখালেন! মাইকেল ক্লার্কের অধিনায়কত্ব ও ব্যাটিংয়ে তিনি মুগ্ধ। প্রশংসায় যাকে বলে পঞ্চমুখ।
কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রসঙ্গ উঠতেই ক্যাটিচের মুখে কুলুপ। একটু নমুনা দেওয়া যাক—
—ভবিষ্যতে ক্লার্কের সঙ্গে বসে কখনো চা-কফি বা বিয়ারে চুমুক দেওয়া হবে?
ক্যাটিচ: (মুখে কোনো কথা নেই, কাঁধ ঝাঁকিয়ে আকর্ণবিস্তৃত হাসি, যেটার অর্থ হতে পারে একটাই, ‘জীবনেও না।’)
—তার মানে ক্লার্ককে এখনো ক্ষমা করতে পারেননি!
ক্যাটিচ: আমার ধারণা, উত্তরটা আপনার জানা (আবার হাসি)।
ক্লার্ককে ক্ষমা করেননি ক্যাটিচ। আঘাতটা এতই তীব্র, কোনো দিন ক্ষমা করবেন বলেও মনে হয় না। ক্যাটিচের ক্যারিয়ারের শেষ অধ্যায়টুকু যাঁরা জানেন, তাঁদের অবশ্য অবাক হওয়ার কথা নয়। ক্যাটিচ-উপাখ্যান নাড়িয়ে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটকেই। ২০১০-১১ অ্যাশেজের মাঝপথে দল থেকে ছিটকে পড়েছিলেন চোট নিয়ে। অ্যাশেজে ভরাডুবি ও ২০১১ বিশ্বকাপ শিরোপা ধরে রাখায় ব্যর্থ হওয়ার পর রিকি পন্টিংকে সরিয়ে নেতৃত্ব দেওয়া হয় মাইকেল ক্লার্ককে। ওই বছরের জুনে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ক্যাটিচ আবিষ্কার করেন, কেন্দ্রীয় চুক্তিতে রাখা হয়নি তাঁকে। তিন বছর ধরে টেস্ট দলের নিয়মিত ওপেনারকে বাদ দেওয়ায় নির্বাচকদের যুক্তি ছিল, ‘ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তারুণ্যকে প্রাধান্য দেওয়া।’ পরে সংবাদ সম্মেলনে বোমা ফাটিয়েছিলেন ক্যাটিচ, ‘আমার বাদ পড়ায় ক্লার্কের হাত আছে। ড্রেসিংরুমের সেই ঘটনার ভূমিকা এখানে না থেকে পারেই না।’
ড্রেসিংরুমের সেই ঘটনা জানতে যেতে হবে তারও আড়াই বছর পেছনে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সিডনি টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর পর সেই সময়ের বান্ধবী লারা বিঙ্গলের কাছে ছুটে যেতে ক্লার্ক চেয়েছিলেন ড্রেসিংরুমে বিজয়সংগীতটা যেন আগেই গাওয়া হয়। এই নিয়ে ক্যাটিচের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি, একপর্যায়ে ক্লার্কের কলার চেপে ধরেছিলেন ক্যাটিচ। ক্যাটিচের দাবি ছিল, অধিনায়ক হওয়ার পর সেই ঘটনারই প্রতিশোধ নিয়েছেন ক্লার্ক।
এরপর সময় গড়িয়েছে। নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে আরও একটা মৌসুম খেলে অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন ক্যাটিচ। কাউন্টিতে দারুণ একটি মৌসুম কাটিয়েছেন হ্যাম্পশায়ারের হয়ে। কদিন আগে আন্ডারডগ পার্থ স্কোর্চার্সকে বিগ ব্যাশের ফাইনালে নিয়ে গেছেন নেতৃত্ব দিয়ে। এখন বিপিএলে খেলতে এসেছেন দুরন্ত রাজশাহীর হয়ে। গত পরশু একাডেমি মাঠে বসে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বোঝা গেল, সময়ের স্রোত আক্ষেপের ওপর খানিকটা পলি জমিয়েছে, ‘শুরু করার সময় যদি বলা হতো ৫০টির বেশি টেস্ট ম্যাচ খেলব, খুশি মনেই মেনে নিতাম। শেষটা অবশ্যই হতাশাজনক ছিল, তবে জীবন তো এমনই, সব চাওয়া পূরণ হয় না। ৫৬টি টেস্ট খেলতে পেরেছি, সেটাই-বা কম কী! চমৎকার একটি পরিবার আছে আমার, বন্ধুবান্ধব...সব মিলিয়ে জীবনটা এমন খারাপ কি!’
বাস্তবতা তাঁকে দার্শনিক করে তুলেছে ঠিকই। কিন্তু ক্লার্কের দেওয়া আঘাত যে এখনো দগদগে, সেটা তো পরিষ্কার করেই দিয়েছেন! ব্যক্তিগত টানাপোড়েন থেকে বেরিয়ে ক্রিকেটার ক্লার্কের মূল্যায়নে অবশ্য উদার ক্যাটিচ, ‘আমি সব সময়ই জানতাম, ও দারুণ এক অধিনায়ক হবে। ওর ট্যাকটিক্যাল মস্তিষ্ক দারুণ। ব্যতিক্রমভাবে ভাবতে পারাই ওকে সফল করে তুলেছে। নিজের ব্যাটিংটাকেও গত এক বছরে ভিন্ন একটা উচ্চতায় তুলে নিয়েছে। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রতিজ্ঞাটা বের করে এনেছে ওর সেরাটাও।’
চুক্তি থেকে বাদ পড়ার পর ক্যাটিচের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন রিকি পন্টিং, শেন ওয়াটসন, শেন ওয়ার্ন, এমনকি প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্টিভেন স্মিথও। দুঃসময়ের সঙ্গীদের হূদয়ে জায়গা দিয়েছেন ক্যাটিচ, ‘রিকি (পন্টিং) ও ওয়াট্টো (ওয়াটসন) প্রকাশ্য আমাকে সমর্থন করেছে। ওয়াট্টো আমাকে সমবেদনা জানিয়ে খুব চমৎকার একটা খুদে বার্তা পাঠিয়েছিল। খুব কঠিন সময় গেছে। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে আর খেলতে পারব না, মেনে নেওয়াটা খুব কঠিন ছিল। অনেক সময় লেগেছে সামলে উঠতে। সে সময় ওদের সমর্থনের কথা আমি কখনোই ভুলব না।’
ক্যারিয়ারের শেষটা দুঃস্বপ্নের মতো, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের একটা দুঃস্বপ্নেরও সাক্ষী তিনি। কার্ডিফে বাংলাদেশের অস্ট্রেলিয়া-বধের ম্যাচে খেলেছিলেন। দুঃসহ স্মৃতিটা ভালোই মনে আছে তাঁর, ‘ওই দিনটাই আমাদের শুরু হয়েছিল বাজেভাবে। ভোর পর্যন্ত নৈশক্লাবে কাটিয়ে বেসামাল হয়ে ফিরল অ্যান্ড্রু (সাইমন্ডস)। ওকে বাদ দেওয়া হয়েছিল বলেই একাদশে আমার সুযোগ মিলেছিল, ২০ বলে ৩০ রানের মতো করেছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশ আমাদের খুব বেশি করতে দেয়নি। এরপর আশরাফুলের অসাধারণ ব্যাটিংয়ের জবাব ছিল না আমাদের। সাইমন্ডসের ঘটনা আর অমন পরাজয় মিলিয়ে সবার মন-মেজাজ ওই দিন প্রচণ্ড খারাপ ছিল।’
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাবের খাতা বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন খেলে যাচ্ছেন স্রেফ মনের আনন্দে। আনন্দের আরেকটা জায়গা তাঁর আগে থেকেই আছে—রান্নাঘর! রান্না করতে খুব ভালোবাসেন, ‘অস্ট্রেলিয়ান সেলিব্রিটি মাস্টারশেফে’ গিয়েছিলেন সেমিফাইনাল পর্যন্ত। ‘বিগ ব্যাশ থেকে সরাসরি এখানে এসেছি, অনেক দিন বাড়ির বাইরে। ছেলেটাকে (দেড় বছরের জেভিয়ার) খুব মনে পড়ছে, বাড়ির রান্নাঘরে ছুটে যেতেও তর সইছে না।’
এটাই এখনকার ক্যাটিচ, ক্রিকেট মাঠের চেয়ে যাঁকে বেশি টানে রান্নাঘর!

No comments

Powered by Blogger.