একাকার মহাসমাবেশ আর মেলা, নতুন বই আড়াই শ’- অমর একুশে গ্রন্থমেলা by মোরসালিন মিজান

 শুরু করতে হবে শাহবাগ মোড় থেকেই। হ্যাঁ, খুব চেনা এই জায়গাটিকে এখন বলা হচ্ছে ‘প্রজন্ম চত্বর।’ যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে নতুন আন্দোলনের সূচনা হয়েছে এখানে।
প্রতিদিনই এতে যোগ দিচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। সঙ্গত কারণেই প্রতিবাদের ঢেউ এসে লেগেছে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে। বিশেষ করে শুক্রবারের মহাসমাবেশ দারুণভাবে প্রভাবিত করে মেলাকে। মেলা আর মহাসমাবেশ এদিন যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। মহাসমাবেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ এসেছেন বইমেলায়। বইমেলা থেকেই যোগ দিয়েছেন মহাসমাবেশে। এভাবে সকাল থেকে রাত অবদি চলে। শুক্রবার সকালেই শুরু হয় মেলা। দিনের প্রথমভাগটি ছিল শিশুদের জন্য। অর্থাৎ শিশুপ্রহর। মেলা শুরু হওয়ার পর প্রথম শিশুপ্রহর ছিল এটি। ফলে অনেক বাবা মা নিজের সন্তানকে মেলায় নিয়ে এসেছেন। বাচ্চারা ঘুরে ঘুরে বই দেখেছে। বই কেনার ক্ষেত্রেও তারা যথেষ্ট এগিয়ে ছিল। ব্যাগভর্তি বই নিয়ে বাড়ি ফিরেছে তারা। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া শিশু প্রহর চলে দুপুর ১টা পর্যন্ত।
বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ জানায়, এবারের মেলার চারটি দিনকে শিশু প্রহর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। শুক্রবার ছাড়াও আজ শনিবার এবং ১৫ ও ২২ ফেব্রুয়ারি থাকবে শিশুদের জন্য।
নতুন বই ॥ শুক্রবার মেলার অষ্টম দিনে নতুন আড়াইশ’র বেশি বই এসেছে। তথ্যকেন্দ্রে জমা পড়েছে ২৫০টি। মেলায় আগামী এনেছে মামুন রশীদের ‘উৎসবের অর্থনীতি’, জাগৃতি এনেছে বদরুদ্দীন উমরের ‘বাংলাদেশের রাজনীতি’, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ‘রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের মতোই, তুষার আবদুল্লাহের ‘অফএয়ার : সিএসবি থেকে যমুনা’, জয়তী থেকে শাহনাজ মুন্নীর ‘ইষ লিবে ডিষ’, আনজীর লিটনের ‘গণজাগরণের কবি নজরুল’, ন্যাশনাল থেকে আনু মাহমুদের ‘খালাস’, কলি প্রকাশনী এনেছে করুণাময় গোস্বামীর ‘বাংলা গানের কথা’, সন্দীপন বসু ‘ভিনদেশী কৌতুক’, নান্দনিক এনেছে আনোয়ার সৈয়দ হকের ‘ঘুম’, ভোরের শিশির এনেছে আসাদ চৌধুরীর ‘এক যে ছিল বোকা রাজা’, অক্ষর এনেছে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুলাহ ‘প্রেমের কবিতা’ সংস্করণ, বিদ্যাপ্রকাশ এনেছে আবদুশ শাকুরে ‘করিবকর্মা, মোহিত কামালের ‘পাথরপরান’, দন্তস্য রওশনের ‘নোটুর সেভেনটি ওয়ান’, লুৎফুন নাহার লতার ‘চাঁদের উঠোন’, কাকলী এনেছে আনিসুল হকের ‘প্রিয়তমাসু’, সুমন্ত আসলামের ‘স্বপনচারিণী’, রোহিত হাসান কিছলুর ‘মি. ফটাশ’, ভাষাচিত্র এনেছে তানভীর তারেকের ‘সিদ্ধ পল্লীর পতিতা’, মারজুক রাসেলের ‘চাঁদের বুড়ির বয়স যখন ষোলো’, শিখা প্রকাশনী এনেছে ইমদাদুল হক মিলনের ‘ভালো যদি বাসো সখি’, অ্যাডর্ন এনেছে উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ‘কুজো বুড়ির কথা’ ও ‘টুনটুনির বুদ্ধি’, শুদ্ধস্বর ফারুক মাহমুদের ‘মহাভারতের প্রেম’, ইকবাল হোসেন চৌধুরী ‘অকবিতা’, আমদা মোস্তফা কামালের ‘অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলে’, প্রিয় প্রকাশ এনেছে মনি হায়দারের ‘অলরাউন্ডার’, সালমা বুক ডিপো থেকে এনেছে, নাজমুল হুসাইন বিদ্যুতের ‘দুঃখবিলাস’, লাভলী বাশারের ‘আমার দ্বাদশ প্রেম’, যুক্ত এনেছে অদিতি ফাল্গুনীর ‘প্রবাল টিয়া টিটো’ ও ‘মহাবিহারে টিয়া টিটো’, পাঞ্জেরী এনেছে আন্দালিব রাশদীর ‘আমলা শাসানো হুকুমনামা ও বিচিত্র গ্রন্থ’, সময় এনেছে খালিদ মাহমুদ মিঠুর ‘হুমায়ূন স্যার ও কিছু স্মৃতি’, কথাপ্রকাশ এনেছে নির্মলেন্দু গুণের ‘মহাজীবনের কাব্য’, প্রিতম এনেছে সেলিনা হোসেনের ‘সখিনার চন্দ্রকলা’, মিজান এনেছে এসএম মুকুলের ‘বহুমাত্রিক হুমায়ূন আহমেদ’।
মোড়ক উন্মোচন ॥ এদিন ১৩টির মতো বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। বইগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ কবিতার জন্য প্রার্থনা, একদিন নক্ষত্র এসে, তিতি ও মিতি, কাক্সিক্ষত রজনী, সর্প, স্বর্গ থেকে স্বপ্ন এনেছে, অনন্ত, জেগে ওঠা প্রেম, রিক্ত ঐশ্বর্য, দোলদার বাসর, কারাগানে ৫৬দিন, বাড়িয়েছি হাত অধরায় ও জয়িতা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মূল মঞ্চের আয়োজন ॥ শুক্রবার মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘হবীবুল্লাহ বাহার : ইতিহাসের ট্র্যাজিক পুরুষ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মফিদুল হক। আলোচনায় অংশ নেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, গবেষক মোরশেদ শফিউল হাসান এবং ড. ইসরাইল খান। সভাপতিত্ব করেন ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক। প্রাবন্ধিক বলেন, ‘হবীবুল্লাহ বাহার বিশ শতকের বাঙালী মুসলমানের প্রগতিবাদী ইতিহাসের ধারায় এক স্মরণীয় নাম। মুসলমান সম্প্রদায়ের মাঝে আধুনিক চেতনার উদ্বোধনে অগ্রণী ভূমিকা ছিল তাঁর যদিও সময়ের নির্মম বিচারের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। ক্রীড়াকুশলতা, পত্রিকা সম্পাদনা, রাজনীতিচর্চা, সংস্কৃতিমনস্কতা ও স্বাস্থ্যসচেতনতা সঞ্চারের মধ্য দিয়ে তিনি আপন সম্প্রদায়কে অগ্রসর অভিযাত্রার দিকে নিয়ে গেছেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ সংসর্গ তাঁর জীবনে সঞ্চার করেছিল নতুন মাত্রা।’
আলোচকবৃন্দ বলেন, ‘হবীবুল্লাহ বাহার সম্পাদিত বুলবুল পত্রিকা বাংলার সাময়িকপত্রের ইতিহাসে বিশিষ্টতার দাবি রাখে। এই পত্রিকার অসাম্প্রদায়িক নীতি ও চেতনা সমকালে ছিল দুর্লভ। সমন্বিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আদর্শের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর সম্পাদকীয় চিন্তাতে। প্রাদেশিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে ঢাকা নগরীকে মশকমুক্ত করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান আজও নগরবিদদের আগ্রহের বিষয়। যদিও চরিত্রের বহুমুখিনতা তাঁকে একক কোন কেন্দ্রে স্থির হতে দেয়নি; ধাবিত করেছে ট্র্যাজিক নিয়তির দিকে।’ সভাপতির বক্তব্যে আহমদ রফিক বলেন, ‘স্বল্পায়ু জীবন পেয়েছিলেন হবীবুল্লাহ বাহার কিন্তু কর্মের বৈচিত্র্যে বহুমাত্রিকতায় ভাস্বর তিনি। সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার কালে তাঁর প্রাগ্রসর-আধুনিক চিন্তাধারা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই যুগন্ধর ব্যক্তিত্বের সঠিক মূল্যায়নে ব্রতী হলে আমরা মূলত আমাদের জাতিগত বৃহত্তর ইতিহাসের উৎসেই ফিরে যাব।’
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে মিজানুর রহমান পান্নার পরিচালনায় খুলনার সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘রূপান্তর’ এবং অসীম সাহার পরিচালনায় ‘সহজিয়া’।
আজকের আয়োজন ॥ শুক্রবার সকাল ১০টায় শিশু-কিশোর সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার প্রাথমিক বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হবে দিনের আয়োজন। বিকেলে মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘অদ্বৈত মলবর্মণ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন শান্তানু কায়সার। আলোচনায় অংশ নেবেন হরিশংকর জলদাস, সফিকুন্নবী সামাদী এবং অদিতি ফাল্গুনী। সভাপতিত্ব করবেন কামাল লোহানী। সন্ধ্যায় পরিবেশিত হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

No comments

Powered by Blogger.