যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়- ১৭ মার্চ উদ্যাপিত

 কৃতজ্ঞ বাঙালী জাতি বুধবার শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করল বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের স্বাপি্নক স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। নানা অনুষ্ঠান এবং বাঙালী জাতির হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা-ভালবাসায় দেশব্যাপী পালিত হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধুর ৯১তম জন্মদিন,
জাতীয় শিশু দিবস। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকরের পর এটাই ছিল জাতির জনকের প্রথম জন্মদিন পালন। তাই এবার জাতির জনকের জন্মদিন পালনে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সাম্প্রদায়িকতা ও কূপমণ্ডকতার বিরম্নদ্ধে লড়াই করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক সোনার বাংলা গড়ে তোলার দুর্জয় প্রেরণা ও ইষ্পাতকঠিন প্রত্যয় ছিল শ্রদ্ধা জানাতে আসা সারাদেশের কৃতজ্ঞ বাঙালীর কণ্ঠে। আলোচনাসভাতেও আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ভেদ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে বাঙালী জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার দৃঢ়অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, "আমাদের ভুলের কারণে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি সংগঠিত হতে পেরেছে, জাতির জনককে হত্যা করে জাতির অগ্রগতির মিছিল থামিয়ে দিয়েছে। আর ভুল করা চলবে না। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ইষ্পাতকঠিন দৃঢ়ঐক্য গড়ে তুলে রাজপথে সতর্ক পাহারায় থাকতে হবে। বাংলার মাটিতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকর করা হবে। কোন ষড়যন্ত্র-চক্রান্তই এ পথ থেকে সরকারকে হটাতে পারবে না।"
এবার এক ভিন্ন মেজাজ ও চেতনায় পালিত হলো জাতির জনকের জন্মদিন। জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে নানা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে শ্রদ্ধা জানায় বঙ্গবন্ধুকে। সরকারী ছুটির দিনে দেশের সব শিৰা প্রতিষ্ঠানে শিশু সমাবেশ, বইমেলা, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং গ্রামগঞ্জ, শহর-বন্দরে মানুষ নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যে মানুষটির জন্ম না হলে বাংলাদেশ হতো না, স্বাধীন মানচিত্র বা স্বাধীন পতাকা পাওয়া যেত না, সেই ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা এবং তাঁর প্রতিকৃতি ফুলে ফুলে ভরে দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। জাতি ও রাষ্ট্রের পৰ থেকে সকালে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি জিলস্নুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সকাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ৩২ নম্বর ধানম-ির বাসভবনের সামনে নেমেছিল কৃতজ্ঞ বাঙালীর ঢল। আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং হাজার হাজার কৃতজ্ঞ বাঙালী বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পসত্মবক অর্পণ করে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেছেন। দিনব্যাপী বিভিন্ন দল এবং সরকারী ও বেসরকারী সংগঠন মিলাদ মাহফিল, আলোচনাসভা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, শিশু সমাবেশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কবিতা আবৃত্তিসহ নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালন করে। তবে প্রতিটি অনুষ্ঠানেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গটি প্রাধান্য পায়। শিশু থেকে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার মুখেই ছিল একই দাবি_ 'বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার হয়েছে, এবার একাত্তরের নরঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই।'
সকালে প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সর্বপ্রথম ধানম-ির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এবং পরে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পসত্মবক অর্পণ করেন তিনি। এ সময় মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, আওয়ামী লীগের জাতীয় ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং সংসদ সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর স্মৃতিঘেরা বঙ্গবন্ধুর বাসভবন স্মৃতি জাদুঘরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘৃণ্য নরপিশাচ ঘাতকচক্র যেখানে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল, জনকের রক্তের দাগ এখনও লেগে থাকা সেই সিঁড়িতে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে স্মরণ করেন তাঁর প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধুকে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আবেগাপস্নুত। শেখ হাসিনার পর বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানায় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনসহ নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও শিশু সংগঠন। কৃতজ্ঞ বাঙালীর ফুলের শ্রদ্ধায় ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। সরকারী ও বেসরকারী টেলিভিশন এবং দেশের অধিকাংশ জাতীয় দৈনিক বিশেষ নিবন্ধ ও অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরেছে বাঙালীর কিংবদনত্মিতুল্য ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার প্রশ্নে দীর্ঘ সংগ্রামী ও মহান আত্মত্যাগের ইতিহাস।
আলোচনা সভা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলৰে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনাসভায় সব সিনিয়র নেতার মুখেই ছিল দৃঢ়অঙ্গীকার_ স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিদের সকল ষড়যন্ত্র-চক্রানত্ম ভেদ করে দ্রম্নত শুরম্ন করা হবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকর করে বাঙালীর ললাটে থাকা কলঙ্ক অবশ্যই মুছে ফেলা হবে।
দলের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রম্নখতে কিছু দেশ চেষ্টা চালাতে পারে, একটি মহল নানা অপতৎপরতা চালিয়ে দেশের মানুষকে বিভ্রানত্ম ও আতঙ্কিত করার চেষ্টা করবে। বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরে স্বাধীনতার শত্রম্নরা জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু আমাদের ইষ্পাতকঠিন ঐক্য ও দৃঢ়তা নিয়ে অভীষ্ট লৰ্যে পৌঁছাতে হবে। পাপের ভারে পঙ্কিল থাকা বাঙালী জাতিকে পাপমুক্ত করতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতেই হবে এবং রায় কার্যকর করতে হবে। উপদেষ্টাম-লীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, আর সেস্নাগান বা দাবি নয়, দ্রম্নত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরম্ন করতে হবে। একাত্তরের নরঘাতক এসব যুদ্ধাপরাধীর বিচার দেখতে দেশের নতুন প্রজন্ম অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেৰা করছে; গভীর প্রত্যাশা নিয়ে মহাজোটকে ভোট দিয়েছে। কালো চশমা পরে এক জেনারেল (জিয়াউর রহমান) সংবিধানকে ৰতবিৰত করে ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। নতুন প্রজন্ম এখন সত্য ইতিহাস জানতে চায়। তিনি বলেন, ৰমতায় থেকে আত্মসন্তুষ্টির কোন সুযোগ নেই, জনগণের প্রত্যাশা আমাদের অবশ্যই পূরণ করতে হবে। ছাত্রলীগ তাদের অতীত ইতিহাসের কথা স্মরণ করে দেশকে এগিয়ে নেবে এমনও প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
সভাপতিম-লীর সদস্য এবং পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, বন্দুকের নল দিয়ে ৰমতা দখলকারীরা আজ নেতা বনেছে। বাঙালীর ঐক্য বিনষ্ট করেছে। শত্রম্নকে ৰমা করে নয়, প্রতিরোধ করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, ২১ আগস্টের তদনত্মে বিএনপি-জামায়াতের রম্নইকাতলাদের নাম বেরিয়ে পড়ায় তারা আতঙ্কিত হয়ে পাগলের প্রলাপ বকছে। সবাইকে সতর্ক করে তিনি বলেন, আমাদের অনৈক্যের কারণেই বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সাম্প্রদায়িক শক্তি সংগঠিত হয়েছে। তাই সেস্নস্নাগান বা দিবস পালনে নয়, নির্মহ-নিরাসক্ত থেকে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।
সভাপতিম-লীর সদস্য আতাউর রহমান খান কায়সারের নেতৃত্বে আলোচনাসভায় আরও বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুব-উল-আলম হানিফ, খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, আহমদ হোসেন, কৃষিবিদ আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি, ফজিলাতুন্নেসা ইন্দিরা এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম। নূহ-উল-আলমের পরিচালনায় আলোচনাসভায় বঙ্গবন্ধুকে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান।
আরও যত অনুষ্ঠান সরকারী ও বেসরকারীভাবে দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালন করা হয়েছে। দিবসটি উপলৰে একটি স্মারক ডাকটিকেট উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর সমাধি কমপেস্নক্সে বুধবার বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলৰে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভোরে দলীয় ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। আয়োজন করে দোয়া মাহফিল, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। বাংলা একাডেমী, শিশু একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, বঙ্গবন্ধু শিশু একাডেমীও আলোচনাসভা, শিশু সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলৰে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল নিজস্ব কার্যালয়ের সামনে সমাবেশের আয়োজন করে। সংসদের আহ্বায়ক মেজর জেনারেল (অব) হেলাল মোর্শেদ খান বীরবিক্রমের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমপি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব) এবি তাজুল ইসলাম এমপি, সংসদের সদস্য সচিব এমদাদ হোসেন মতিন, সুলতান আহমেদ রাজা ও আসাদ উলস্নাহ। সচিবালয়ের ক্যান্টিনে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে। জাতীয় প্রেসকাবে 'বঙ্গবন্ধুর শিৰা ভাবনা' শীর্ষক আলোচনাসভার আয়োজন করে জাতীয় শিৰক কর্মচারী ফ্রন্ট। এছাড়া কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ, বঙ্গবন্ধু শিৰা ও গবেষণা পরিষদসহ অসংখ্য সংগঠন আলোচনাসভা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে স্মরণ করে জাতির পিতাকে।
৩২ নম্বরে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে পুষ্পসত্মবক অর্পণের মাধ্যমে আরও শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিকলীগ, কৃষকলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, তাঁতী লীগ, হকার্স লীগ, বঙ্গবন্ধু শিশু একাডেমী, বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ, বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ, অগ্রণী ব্যাংক কর্মচারী সংসদ, জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ, আওয়ামী তরম্নণ লীগ, ধানম-ি থানা আওয়ামী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা জনতা লীগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ সাহিত্য লীগ, জয়বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট, বাকশাল, প্রতিরোধ যোদ্ধা পরিষদ, শেখ রাসেল শিশু-কিশোর পরিষদসহ অজস্র সংগঠন।

No comments

Powered by Blogger.