সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের একুশের অনুষ্ঠানমালা শুরু

বায়ান্নর একুশের খরস্রোতা পথ ধরে এসেছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নিয়েছিল বাঙালীর স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে মুক্তিযুদ্ধের আলোকিত চেতনায় শুরু হলো অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা।
এবারের সেøাগান একুশ আছে জয়োদ্ধত/ একুশ বাঁচে অবিরত। ১৯৮৪ সালে এই একুশের অনুষ্ঠানমালা দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। একইসঙ্গে জোটের প্রতিষ্ঠা এবং এ আয়োজনের তিন দশক পূর্তি হচ্ছে এ বছর। তাই অনুষ্ঠানসূচীতেও রয়েছে বৈচিত্র্যময়তা। দেশের শীর্ষ স্থানীয় বাইশটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের গান, নাটক, আবৃত্তি পরিবেশনার সঙ্গে থাকছে ছয়টি সেমিনার।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সোচ্চার ধ্বনিতে শুক্রবার বিকেলে দুই সপ্তাহব্যাপী এ অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। আয়োজনের শুরুতেই দেশের সব আন্দোলনের সব শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মিনারের বেদিতে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা হয়। এরপর সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হয় জাতীয় সঙ্গীত। আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসিÑ এই মধুময় উচ্চারণ শেষে শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে পালন করা হয় এক মিনিটের নীরবতা। নীরবতা থেমে গেলে ভেসে আসে ভাষার গান। সমবেত কণ্ঠে গীত হয় আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আামি কি ভুলিতে পারি।
অনুষ্ঠানমালা উদ্বোধন করেন একুশের প্রথম শহীদের ছবি তোলা আলোকচিত্রী ও ভাষাসংগ্রামী আমানুল হক। কথামালায় অংশ নেন গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতি লিয়াকত আলী লাকী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহ-সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আহ্্কাম উল্লাহ্ ও আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। সভাপতিত্ব করেন পথনাটক পরিষদের সভাপতি মান্নান হীরা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাকশিল্পী রফিকুল ইসলাম।
উদ্বোধনী বক্তব্যে আমানুল হক বলেন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের এই এলাকা থেকেই বায়ান্নর এই মাসে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। ভাষা আন্দোলনে প্রাণ বিসর্জনকারীদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। এরপর তাঁর কথায় উঠে আসে যুদ্ধাপরাধীদের প্রসঙ্গ। বলেন, মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় পরাজয় ঘটে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার। এরপর থেকেই বেইমান শব্দটির প্রতিশব্দ হয়ে ওঠে মীরজাফর। এখন থেকে বেইমানের প্রতিশব্দ হবে রাজাকার। কারণ, এই কুলাঙ্গাররা বিজাতীয়দের কাছে দেশের স্বাধীনতাকে তুলে দিতে চায়। জয় বাংলা সেøাগানে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ করেন তাঁর বক্তব্য।
গোলাম কুদ্দুছের বক্তব্যে উঠে আসে সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার প্রচলিত না হওয়ার আক্ষেপ। বলেন, যে ভাষার জন্য এই জাতি প্রাণ দিয়েছিল সেই বাংলাভাষা যেন দিন দিন পরবাসী হয়ে যাচ্ছে। এখনও সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বাংলাভাষার ব্যবহার হয় না। সংবিধানে শুধু রাষ্ট্রভাষা বাংলা লেখা থাকলে চলবে না, সর্বস্তরে প্রয়োগের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। আদালতের রায়ের ভাষায় বাংলা ব্যবহার করতে হবে।
অন্য বক্তারা বলেন, একুশের পথ ধরেই এসেছিল মুক্তিযুদ্ধ। আর শহীদ জননী জাহানারা ইমাম প্রথম গণআদালত গঠনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের প্রতীকী ফাঁসির রায় ঘোষণা করেছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের শহীদ জননীর সেই আন্দোলনের নির্যাস এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। একাত্তরের পাপীদের বিচারের দাবিতে ফুঁসে উঠেছে তরুণ সমাজ। এ অবস্থায় জোটের দাবি আগামী চার মাসের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে। আর যুদ্ধাপরাধী জামায়াত ও তাদের অনুচর শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে করতে হবে।
আলোচনা শেষে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শুরুতেই গান শোনান গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের শিল্পী। সমবেত কণ্ঠে গীত হয়Ñ ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া লইতে চায়, জয় বাংলা বাংলার জয় ও ভয় কি মরণেসহ বেশ কিছু গান। সমবেত গান শেষে একক কণ্ঠে গান শোনান সমর বড়ুয়া। সব শেষে ছিল মান্নান হীরা রচিত ও নির্দেশিত আরণ্যক নাট্যদলের পথনাটক খেকশিয়ালের প্রদর্শনী।
আজ শনিবার থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল চারটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে চলবে একুশের অনুষ্ঠানমালা। উনিশ, বিশ ও একুশ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠান হবে ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবরের উন্মুক্ত মঞ্চে। অনুষ্ঠানমালায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের পরিবেশনায় থাকবে গান, নাটক, আবৃত্তিসহ নানা আয়োজন। এবারের অনুষ্ঠানে আংশগ্রহণ করবে দেশের প্রথম সারির বাইশটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। সাংস্কৃতিক আয়োজনের পাশাপাশি অনুষ্ঠানমালায় থাকবে ছয়টি সেমিনার।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবিতে ছায়ানটের মানববন্ধন
একাত্তরের পাপীদের বিচারের দাবিতে আজ উত্তাল সারাদেশ। যুদ্ধাপরাধী কিংবা মানবতাবিরোধীদের বিচারের সোচ্চার দাবিতে প্রকম্পিত রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ। তরুণ-যুবা, মধ্যবয়সী, পৌঢ় কিংবা শিশুসহ শিল্পী, কবি, সাংবাদিক, মেহনতী মানুষের নির্ভীক কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে রাজাকারের ফাঁসির দাবি। আর সময়ের সুতীব্র এ দাবির সঙ্গে শুক্রবার একাত্ম হলো ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। সকালে সংগঠনের পক্ষ থেকে ‘সংস্কৃতি-বিনাশী, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই’ ধ্বনি তুলে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। শংকরে অবস্থিত ছায়ানট ভবনের সামনে থেকে সকাল ১১টায় শুরু হয় মানববন্ধন। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মচারী, সুহৃদ, সচেতন নাগরিকসহ আপমর মানুষ অংশ নেয় এ মানবন্ধনে। সহস্রাধিক মানুষের অংশগ্রহণে ধানম-ির সাতাশ নম্বর মোড় থেকে আবাহনী মাঠ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে হাতে হাত মেলানো এ বন্ধন ।
মানববন্ধনের শুরুতেই ছায়ানটের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা হাতে হাত মিলিয়ে সমবেত কণ্ঠে গেয়ে যান বেঁধেছি দাঁড়া দেখি/বারে বারে হেলিস নারে ভাই। এরপর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন ছায়ানটের সহ-সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী। তিনি বলেন, ছায়ানট শুধুমাত্র একটি গানের স্কুল নয়, জন্মলগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটি দেশের গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক সকল আন্দোলনেই ছায়ানটের সোচ্চার ভূমিকা রেখেছে। আজ আমরা দেশের এমন এক ক্রান্তিলগ্নে সমবেত হয়েছি, যখন আবার জেগেছে বাঙালীর অস্তিত্বের প্রশ্ন। গত ২০ জানুয়ারি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কুখ্যাত আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের মানবতাবিরোদী অপরাধে ফাঁসির রায় প্রদান করেছে। একইসঙ্গে জামায়াত ইসলামী ও তাদের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘকে যুদ্ধাপরাধ সংগঠিত করার অন্যতম রাজনৈতিক দল হিসেবে চিন্থিত করেছে। ইতোমধ্যে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার একাত্তরের যুদ্ধপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় ঘোষিত হয়েছে। ফাঁসির পরিবর্তে তাঁকে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদ-। অসংখ্য সাধারণ মানুষসহ কবি মেহেরুন্নেছার হত্যাকারী হিসেবে চিন্থিত এই যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ার বিষয়টি জাতির জন্য অত্যন্ত বেদনার। আমরা দাবি জানাই রাষ্ট্রপক্ষ এ বিষয়ে আরও বেশি সোচ্চার হবে এবং সর্বোচ্চ শাস্তি বিধানে সচেষ্ট হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সর্বোচ্চ শাস্তির দাবির সঙ্গে ছায়ানটের আদর্শের আত্মিক যোগ রয়েছে। এ সব ব্যাপারে সঙ্গীতের মধ্যদিয়ে প্রত্যেক সচেতন মানুষের মধ্যে গণজাগরণ সৃষ্টিতে ছায়ানট অতীতে যেমন একাত্মতা ঘোষণা করেছে, এখনও তেমনি জাতির সঙ্গে এক কাতারে আছে।’
গণসঙ্গীত পরিবেশনা ও প্রতীকী অবস্থানের মধ্যদিয়ে ঘণ্টাব্যাপী চলে এ মানববন্ধন।
আনন্দ-উচ্ছ্বাসে দিনভর চাঁপাই উৎসব ॥ চলো জি ভাই চাঁপাই উৎসবে যাই সেøাগানে অনুষ্ঠিত হলো চতুর্থ চাঁপাই উৎসব। জীবিকার তাগিদে ঢাকায় বসবাস করছেন অসংখ্য চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী। আর তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় করতে গত তিন বছর ধরে এ উৎসবের আয়োজন করছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সমিতি। সমিতির আয়োজনে শুক্রবার সকাল থেকেই রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে শুরু হয় উৎসব। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নানা সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, আলোচনা, খেলাধুলা, ভোজনসহ প্রাণবন্ত আড্ডায় মুখরিত থাকে উৎসব প্রাঙ্গণ। মজার এ আয়োজনে সমবেত হয় দুই হাজারেরও বেশি চাঁপাইবাসী।
সকাল আটটায় কালাইয়ের রুটির নাশতা পরিবেশন করা হয় সবার মাঝে। সকাল দশটায় জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে উৎসবের উদ্বোধন করা হয়। এরপর বসে আলোচনা ও গুণীজন সংবর্ধনা পর্ব। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গুণী চলচ্চিত্র নির্মাতা অহিদুজ্জামান ডায়মন্ডকে দেয়া হয় গুণীজন সংবর্ধনা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা প্রফেসর ইমেরিটাস ড. নাজমা চৌধুরী। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বৃহত্তর রাজশাহী জেলা সমিতির সভাপতি প্রফেসর ইউনুস আলী দেওয়ান, রাজশাহী জেলা সমিতির সভাপতি প্রকৌশলী আমিনুল হক, নাটোর জেলা সমিতির সভাপতি মেজর জেনারেল আমজাদ হোসেন চৌধুরী (অব.) ও নওগাঁ জেলা সমিতির সভাপতি মোঃ শাখাওয়াত হোসেন।
স্বরকল্পনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দুই দিনের আবৃত্তি উৎসব ॥ সতেরো বছরে পা রাখল আবৃত্তি সংগঠন স্বকল্পন আবৃত্তিচক্র। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে দুই দিনবাপী আবৃত্তি উৎসব। সত্য শিবিরে মুক্তি পাগল অভয় মন্ত্র বাজা/মিথ্যের দ্বার ভেদ করে আজ ঘৃণ্যরে দা সাজা সেøাগানে সকাল থেকে শুরু হয় উৎসব আয়োজন। সকাল দশটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বর থেকে বের করা হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাকশিল্পী কাজী আরিফ।
বিকেলে শিল্পকলা একাডেমীর এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে বসে উৎসব উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা। উৎসব উদ্বোধন করেন খ্যাতিমান আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়।

No comments

Powered by Blogger.