মঞ্চের প্রাণ পুরুষ

বাংলাদেশের নাট্য জগতে উজ্জ্বল একটি নাম মামুনুর রশীদ। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর এদেশের মঞ্চ নাটকে যে নবজাগরণ সূচিত হয়েছিল সে জাগরণের নিবেদিতপ্রাণ এক সৈনিক তিনি।
মঞ্চ সংগঠক, অভিনেতা ও নাট্যকার। নির্দেশক হিসেবে বহুমুখী প্রতিভা তাঁর। মঞ্চের পাশাপাশি ১৯৬৭ সাল থেকে সক্রিয় আছেন টেলিভিশন মাধ্যমে। সেখানেও তিনি নাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচারক হিসেবে স্বপ্রতিভায় উজ্জ্বল। তিনি বাংলাদেশ গ্রম্নপ থিয়েটার আন্দোলনের নেতা। আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে এক সহযাত্রী। নানা সামাজিক সংস্থার কাজেও তিনি জড়িত। বরেণ্য এই নাট্যকারের জন্ম ২৯ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৪৮ সালে টাঙ্গাইল জেলায়। নিজের কাজ মিডিয়া ও থিয়েটার চিন্তা নিয়ে। সম্প্রতি তিনি কথা বলেছিলেন আনন্দকণ্ঠের সঙ্গে।
আপনার কাজের পদচারণা নানা দিকে। অভিনয়, নির্দেশনা, ভিজু্যয়াল মিডিয়া, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে । এতদিকে সমন্বয় করেন কি করে?
_এটা খুব কঠিন কাজ এ জন্য নয় যে, আমার কাজগুলো একটা সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। সেটা হচ্ছে প্রথমত মানুষ, দ্বিতীয়ত মানুষের কল্যাণ এবং তৃতীয়ত সমাজের অভ্যনত্মরে যে দ্বন্দ্বগুলো কাজ করছে_মানুষে মানুষে বঞ্চনা, বৈষম্য এগুলোকে আমার নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরা। বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এই কারণেই। বিশেষ করে আপনি হয়তো লৰ্য করেছেন যে, আদিবাসীদের মুভমেন্টের সঙ্গে আমি জড়িত। ওরা এদেশের সংখ্যালঘুদের সংখ্যালঘু। তারাও নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। ওদের নিরাপত্তার প্রশ্নে আমরা যদি বাঙালীরা তাদের পাশে দাঁড়াই তাহলে ওরা অনেক নিরাপদবোধ করে। আবার আমি যে লেখালেখি করি, এই কাজটা দুরূহ। এটা আমি একাকী করি, কেউ আমাকে সাহায্য করে না। যেহেতু আমি আন্দোলন করি সেহেতু আমার লেখাগুলো যাতে পোস্টার না হয় সেদিকে লৰ্য রাখতে হবে। দেখা যায় যে, অনেকে রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন তাদের লেখাগুলো অনেকটা পোস্টার হয়ে যায়। অথবা নাটকের ছদ্দবেশে প্রবন্ধ লেখেন। এ বিষয়টা নিয়ে সজাগ থাকতে হয়। আর এটা প্রতিযোগিতার যুগ_আমাকে মঞ্চে ভাল করতে হবে, মিডিয়াতেও ভাল করতে হবে, অভিনয়টাও ভাল করতে হবে, কাজেই সবটুকু ছেড়ে দেই আমার সততার ওপর।
ঢাকার মঞ্চে নতুন পুরাতন অনেক নাট্যদল নিয়মিত নাটক প্রদর্শন করছে। বর্তমানে মঞ্চ নাটকের মান নিয়ে আপনি কতটুকু সন্তুষ্ট?
_মঞ্চ নাটকের সবের্াপরি যে মান সেখানে একটা পার্থক্য আছে। তবে যে নাটকগুলো ভাল বলে বিবেচিত হচ্ছে তার মান সত্যই ভাল। এবং পৃথিবীর কোন দেশেই বলা যাবে না যে সবগুলো নাটক ভাল হয়। আমাদের দেশে যদি হাতেগোনা চার-পাঁচটি নাটকও ভাল হয়, মাসে যদি আমরা নতুন পুরাতন মিলে ১০টি নাটকও দর্শকদের সামনে তুলে ধরতে পারি, তো আমি মনে করি সেটাই যথেষ্ট।
বর্তমানে টিভি নাটকে আগের মতো কালজয়ী কোন নাটক সৃষ্টি হতে দেখা যাচ্ছে না। এমনটা কেন হচ্ছে?
_এখন হওয়া মুশকিল। কারণ হচ্ছে যে, আমরা যখন ওই নাটকগুলো দেখতাম_'সংশপ্তক', 'বহুব্রিহী'; আমার লেখা 'একটি সেতুর গল্প', 'সুপ্রভাত ঢাকা।' তখন শিল্পীদের জন্য এত চ্যানেল ছিল না। তাই শিল্পীরা সব সময় ফোকাসে থাকত। নাটকের আগে মহড়া করত। এখন তো কোন মহড়া হয় না। আমি কাউকে দোষারোপ করতে চাই না। এত ব্যসত্ম_শিল্পীরা, কলাকুশলীরা, বিটিভি নামে যখন একটি মাত্র চ্যানেল ছিল, তখন আমরা মনে করতাম বিটিভির নাটক একটা শিল্প। এখন কিন্তু এটা আমরা আর মনে করি না। এখন নাটকের পেছনে শত শত কোটি টাকা পুঁজি বিনিয়োগ হচ্ছে। সরকারী চ্যানেল বিটিভি ছাড়া অন্যান্য সব চ্যানেলগুলোকে অর্থনৈতিক দিকটা আগে বিবেচনায় আনতে হয়। যার ফলে নাটকের মান নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটা আর লৰ্য করা যাচ্ছে না। কিন্তু সম্প্রতি আমি দেখতে পাচ্ছি যে অনেক চ্যানেলই ভাবছে যে নাটকগুলো শিল্পোত্তীর্ণ হওয়া প্রয়োজন। তবে দু-চারটা নাটক কিন্তু এখনও ভাল হচ্ছে।
বাংলাদেশ স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশের পর থেকে নতুন প্রজন্ম এখন ঝুঁকছে ভিজু্যয়াল মিডিয়ার দিকে। আবার যারা অভিনয় শিখতে মঞ্চে আসছে, একটা সময় তারাও চলে যাচ্ছে মিডিয়াতে। কেউ কেউ মঞ্চেই আর ফিরছে না। আপনার কি মনে হয় না এতে মঞ্চে একটা সঙ্কটের সৃষ্টি হচ্ছে?
_হঁ্যা। তা তো হচ্ছেই। কিন্তু এটাও ঠিক মঞ্চ এমন একটা মিডিয়া যেখান থেকে কারও জীবিকা নিশ্চিত করা সম্ভব না। আমি ৪৫ বছর ধরে মঞ্চ করছি কিন্তু এখন পর্যনত্ম মঞ্চ থেকে জীবিকা নিশ্চিত করতে পারিনি। আমার কিন্তু জীবিকা আসছে ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া থেকে। এক সময় বিটিভি ও অন্যান্য জায়গায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হতো। এখনও পুরো জীবিকার কাজটা আসছে কিন্তু টিভি মিডিয়া থেকে। এখনও অনেকে টিভি ও মঞ্চ দুদিকেই সময় দিতে পারে আর যারা পারে না তাদেরকেও আমি দোষারপ করবো না। কারণ হচ্ছে যে দু নৌকায় পা দিয়ে যদি কোনটাতেই ভাল করা না যায় তার চেয়ে একটাতে ভাল করাই ভাল। আর একজন অভিনেতা যিনি ভাল অভিনয় করেন, তিনি শুধু মঞ্চেই নির্দিষ্ট থাকবেন এটা আমি বিশ্বাস করি না।
মঞ্চে তারকা শিল্পীদেরও কিন্তু সংকট। এক সময় সুবর্ণা মুসত্মফা, আফজাল হোসেন, অথবা জাহিদ হাসান, তৌকীর, বিপাশা হায়াত তাদের অভিনয় দেখার জন্য দর্শক মঞ্চে আসতো ?
তার আর দরকার নেই। এখন যারা মঞ্চে নাটক দেখতে যায় তারা কিন্তু সবের্াপরি একটা ভাল নাটক দেখতেই যায়। আমি মনে করি এটা আমাদের মঞ্চ নাটকের জন্য একটা ভাল দিক। আমি আমাদের নাট্যদল আরন্যকের উদাহরণ দিতে পারি, আমাদের দলেও কিন্তু অনেক তারকা ছিলেন আজিজুল হাকিম ছিলেন, ফজলুর রহমান বাবু, তুষার কান সহ অনেকেই ছিলেন। একটা পর্যায়ে গিয়ে দেখলাম তাদের ব্যসত্মতা বেড়ে গেল। যখন আমি সংক্রানত্মি নাটকটি করি, সংক্রানত্মি করার সময় চঞ্চল চৌধূরী, খ ম হাসান তারাও স্টার হয়ে গেল পরবতর্ীতে যখন রায়াং যারি তখন চঞ্চল চৌদুরী ও হাসান থাকলেও আর কেউ থাকেনি। নতুনদের নিয়ে কাজ করেছি। সে নাটকটিরও কিন্তু শততম মঞ্চায়ন হয়ে গেল। আবার এবং বিদ্যাসাগর নাটকে পুরোনোদের মধ্যে আমি, মোসেনা চৌধুরী, তমালিকা কর্মকার থাকলাম। তাতেতো কোন সমস্যা হচ্ছে না। আপনি যদি প্রাচ্য নাটকের দিকে তাকান তাহলে দেখবেন যে সেখানে সেখানকার নাটকে দু একজন স্টার ইমেজের শিল্পী থাকে। আমার কাছে এটা ইতিবাচক হলে হয় যে দর্শক এখন ভাল নাটক দেখতে আসে, তারকা দেখতে আসে না। ভাল নাটক হলে তা চলবে। আর ভার নাটক না হলে তা চলবে না।
মুক্তিযুদ্ধের নাটক তেমন একটা হচ্ছে না। এ বিষয়ে কিছু বলুন ?
মুক্তিযুদ্ধের নাটক কিন্তু প্রচুর হচ্ছে। হয়তো ঢাকার মঞ্চে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু ঢাকার বাইরে হচ্ছে ঢাকাতেও হয়েছে। সময়ের প্রয়োজনে নামে একটি নাটকের কথা বলতে পারি এটি আমার দৃষ্টিতে চমৎকার একটি নাটক। আমি ১৯৯৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা মঞ্চ নাটক করেছিলাম নাম জয় জয়নত্মী। নাটকটি দারম্নন জনপ্রিয় হয়েছিল। আসলে সময় যত গড়াবে এ ধারার নাটকগুলো আরও ভিন্নতা পাবে।

No comments

Powered by Blogger.