রাজশাহীর ছাত্রহত্যা, ছাত্রশিবির ও ছাত্র রাজনীতি by ড. মোঃ হারুন-অর-রশীদ

বাংলাদেশে অতীত ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস অতীব গৌরবোজ্জ্বল মহিমায় ঐতিহ্যমণ্ডিত; অহংদীপ্ত এবং অবিস্মরণীয়। ১৯৫২-এর রক্তাক্ত সফল ভাষা আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে নানান মরণপণ সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ ছাত্র রাজনীতির স্বর্ণফসল।
কিন্তু চলমান ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে তার আকাশ-পাতাল প্রভেদ। এখনকার ছাত্র রাজনীতি অর্থলোলুপতায় কেদাক্ত, শক্তিমদমত্ততায় পাশববৃত্তিক, নিষ্ঠুরতায় নজিরবিহীন এবং অমানবিক ঘৃণ্যতায় কলুষদীপ্ত। যার নিকটতম দৃষ্টানত্ম ৮ ফেব্রম্নয়ারি, ২০১০-এ দিবাগত রাতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের হাতে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় এক ছাত্র খুন এবং প্রায় অর্ধশতাধিক ছাত্রকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়ে নির্মমভাবে জখম ও চিরতরে পঙ্গু করে দেয়ার বীভৎস ঘটনা। এরকম ঘটনার ঘৃণা জানানোর ভাষাও দুর্লভ। একই মাত্রার না হলেও, ছাত্রলীগের অনত্মর্কোন্দলের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর এক ছাত্রের মৃতু্যর ঘটনাও মর্মানত্মিক ও বেদনাবিধুর। কিন্তু ছাত্রশিবিরের ঘটনা সভ্যতাবিবর্জিত, আদিম, হিংস্র মানসিকতার জঘন্য নিদর্শন। পরিশ্রম্নত ও পবিত্র মানবতার কলঙ্ক। বিচার ও মূল্যবোধের নিলর্জ্জ অবমাননা। যেমন ছিল ২০০১ সালে ৰমতায় আসা বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে ছাত্রদলের নির্বিচার হত্যা, খুন, জখম, ধর্ষণ এবং সংখ্যালঘু নিপীড়ন। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়কাল থেকেই জামায়াতে ইসলামী পাক-হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে সক্রিয় ধ্বংসাত্মক ভূমিকা পালন করে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের বিপ েপরিচালনা করেছে নানাবিধ কলঙ্কময় ন্যক্কারজনক কর্মকা-_লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগ ও ধর্ষণ। শুধু তাই নয়, এরা ধর্মের নামে হত্যা করেছে অসংখ্য সাধারণ নিরীহ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাকে। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে যুদ্ধাপরাধী এই দলটি ও তার অঙ্গ সংগঠন; আজকের ইসলামী ছত্রিশিবির তার স্বভাবগত ও জন্মগত কেদময়তা, নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতা সমান তালে প্রদর্শন করে চলেছে একানত্ম নিলর্জ্জভাবে। যার শেষতম নিদর্শন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর্যুক্ত ছাত্র হত্যাযজ্ঞ।
কিন্তু পাকিসত্মান সরকারের পোষ্য ছাত্র সংগঠন এনএসআই ব্যতীত অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোর এমনতর ঘৃণ্য বৈশিষ্ট্য ছিল না। ১৯৭৫-এর পর ঐতিহ্যবাহী ছাত্র রাজনীতি স্বচ্ছ গতিধারা হারিয়ে পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত হতে থাকে সামরিক জানত্মা জেনারেল জিয়াউর রহমানের অপহসত্মেেপর ফলে। সঠিক করে বলতে গেলে, পরীায় এক্সেলেন্ট রেজাল্ট করা মেধাবী ছাত্রদের নিয়ে যে দিন জেনারেল জিয়া সমুদ্রবিহারে যান এবং সম্মাননা জ্ঞাপনের নামে অভির মতো মেধাবী ছাত্রকে করায়ত্ব করে হাতে অর্থ ও অস্ত্র তুলে দেন। সে দিন থেকে লোভাতুর ছাত্রদের কাছে বিদ্যা হয়ে পড়ে 'গ্রন্থগত' এবং হসত্মগত অস্ত্র অর্থার্জনের হাতিয়ার। অতঃপর যা হওয়ার তাই হয়। রোপিত হয় সেই বিষবৃৰের বীজ যা ঘোষণা করেছিলেন জেনারেল জিয়া, 'আমি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তুলব।' এবং তিনি তাঁর কথা রৰা করেছিলেন ছাত্রদলের জন্ম এবং ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়ে অরে অরে। সেই থেকে ছাত্র রাজনীতির অবয় শুরম্ন এবং রাজনীতির নীতি বিসর্জন ও রাজনীতিকের চরিত্র হনন।
তাঁর আর এক অবিস্মরণীয় সর্বনাশা উক্তি, 'মানি ইজ নো প্রবলেম।' বিষাদসিন্ধু উপন্যাসে মীর মশাররফ হোসেন যে বলেছিলেন, 'অর্থই অনর্থের মূল' সেটা বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের েেত্র প্রায় শতভাগ সত্য হয়ে দেখা দিল। পয়সার বিনিময়ে বিক্রি হয়ে গেল ছাত্রদের প্রতিভা; রাজনীতিকের মেধা। অর্থাৎ রাজনীতি থেকে সরস্বতীর বিদায় এবং লক্ষ্মীর আবির্ভাব ঘটল। এ লক্ষ্মীও প্রকৃত লক্ষ্মী নয়, শাক চুনি্নর মতো অলক্ষ্মী অপয়া। অথবা বলা যায়, অপরাজনীতির ভূত। জিয়াউর রহমানের পাতা জালে ধরা পড়ল, সর্বখাদক সব নেতা এবং সর্বভুক সব রাঘববোয়াল। ছাত্রতো কোন ছাড়! যেমন গুরম্ন তেমন শিষ্য! ফলে রাজনীতিক আজ নীতিভ্রষ্ট,/প্রীতিভ্রষ্ট, বিবেক নাই/মনুষ্যত্বের ধার ধারে না/নির্লজ্জ সব স্বার্থের চাঁই। ছাত্র রাজনীতির বেলায় কথাটা আরও সত্য। ভাড়া খাটা পা-া সব; কখনও অর্থের বিনিময়ে, আবার কখন বা কথাকথিত আদর্শের ভাঁওতাবাজিতে। ছাত্রশিবিরের েেত্র আরও কদর্য; ধর্মের বুলি আওড়িয়ে নিশ্চিত স্বর্গ প্রাপ্তির প্রলোভন দেখিয়ে। এককথায়, রাজনীতিসংশিস্নষ্ট ছাত্ররা আজ 'নষ্ট শসা পচা চাল কুমড়োর মতো/যে সব হৃদয় ফলিয়াছে/সেই সব'_নষ্ট পচা হৃদয়ের মতো হৃদয়বান। এর মধ্যে পালের গোদা আবার ছাত্রশিবির! এরা হৃদয়হীনতার ইমামে আজম; নিষ্ঠুরতার শাইখে হাদিস। এদের সঙ্গে পবিত্র ধর্ম ইসলামের আদর্শিক পরিচ্ছন্নতা ও সর্বমানবিক কল্যাণকামিতার কোন সম্পর্ক নেই। ধর্ম নিয়ে এরা নোংরা রাজনৈতিক খেলায় উন্মত্ত। এদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা জাতি-ধর্ম-রাষ্ট্রের বৃহত্তম মঙ্গলের জন্যই জরম্নরী। একই সঙ্গে কালগত বিবর্তনে বখে যাওয়া এবং গৌরবময় অতীত ঐতিহ্য হারানোর দায়ে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোরও বিলুপ্তি সাধন প্রয়োজন। এ করণে যে, সংগঠনগুলো এখন ক্যান্সারাক্রানত্ম। মতাসীন সরকারের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের অভ্যনত্মরীণ কোন্দলান্দল, আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রাণপণ লড়াই, টেন্ডারবাজি, বখরাবাজি, অর্থলোলুপতা-শিাঙ্গনে ভর্তিবাণিজ্য এবং নানা প্রকার নৈরাজ্য সৃষ্টি জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। প্রশ্ন উঠছে, সরকারের নিরপেতা, স্বচ্ছতা, কর্মদতা নিয়ে। এতএব, ঘর সামলানো জরম্নরী। জরম্নরী আগে আত্মশুদ্ধি অর্জন। আত্মশক্তি বৃদ্ধি, বাজার নিয়ন্ত্রণ, বিদু্যত ও জ্বালানি সঙ্কট নিরসন। সেই সঙ্গে সব রকম হত্যা মামলার সুষ্ঠু নিরপে বিচার সম্পন্ন করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার দৃষ্টানত্ম স্থাপন করা এবং আইন শৃঙ্খলার উন্নতি সাধনের মাধ্যমে জনমনে স্বসত্মি ফিরিয়ে এনে সরকারের প্রতি আস্থা প্রবৃদ্ধি করা।
আমার তো মনে হয়, অতীত ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করে এখন আর ছাত্র রাজনীতি চলতে দেয়া বাঞ্ছনীয় নয়। ক্যান্সারাক্রানত্ম কোন ব্যক্তি যৌবনে সুস্থ, নীরোগ ও নির্মল দেহের অধিকারী ছিল বলে বেঁচে থাকার তাগিদে আক্রানত্ম অঙ্গ অপারেশন করে কেটে বাদ দেয়া সমীচীন হবে না_এ কথা বলা যেমন অযৌক্তিক, বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি টিকিয়ে রাখার প েযুক্তি দেখানও তেমনি অযৌক্তিক। অবশ্য, সর্বপ্রকার দুর্বৃত্তায়ন মুক্ত করে নির্লোভ-নির্মোহ-নিরাসক্ত দেশপ্রেমের স্বচ্ছ নির্মল ধারায় যদি কোন উপায়ে ছাত্র রাজনীতির পূর্ব ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা যায়, সেটা স্বতন্ত্র কথা। সেটা সম্ভবত সম্ভব নয়। বিশেষ করে, নষ্ট-পচা-গলিত, স্খলিত, মধ্যযুগীয় বর্বরতায় বিকৃত ও মানবতাবিরোধী আদর্শধারী ইসলামী ছাত্রশিবিরের পরিশ্রম্নত মনমানসিকতা ফিরিয়ে আনা অবস্থাদৃষ্টে একেবারেই অসম্ভব বলে মনে হয়।
অতএব, যা করতে হয়, করতে হবে এখনই; অনতিবিলম্বে।

লেখক : প্রফেসর, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.