হাসিনা হত্যা মিশন ব্যর্থ হওয়ায় তাজউদ্দিনকে হাওয়া ভবনের ভর্সনা- জিজ্ঞাসাবাদে মুফতি সালামের তথ্য by গাফফার খান চৌধুরী

 গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনা বেঁচে যাওয়ায় হাওয়া ভবন থেকে আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন চরম তিরস্কৃত হয়েছিল। বলা হয়েছিল, আসল কাজই (শেখ হাসিনাকে হত্যা) করতে পারলি না, শুধু শুধু দুর্নাম রটালি।
জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির (আইডিপি) প্রধান ও আফগানফেরত মুজাহিদদের কমান্ডার মুফতি আব্দুস সালাম জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দাদের এসব তথ্য জানায়। শেখ হাসিনাকে হত্যার বিষয়টি ছিল তৎকালীন সরকারের হাইপ্রোফাইল এ্যাসাইনমেন্ট।
শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য পাকিসত্মান থেকে প্রায় ২শ' গ্রেনেড আনা হয়। চট্টগ্রাম থেকে পাকিসত্মানী নাগরিক মজিদ বাট গ্রেনেডগুলো তাজউদ্দিনকে এনে দেয়। এর মধ্যে প্রায় ১শ' গ্রেনেড এদেশে রাখা হয়। বাকি গ্রেনেড ভারতের কাশ্মীরী মুজাহিদদের কাছে হসত্মানত্মর করে তাজউদ্দিন।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ হাওয়া ভবনের কর্তাব্যক্তিরা শুধু তাজউদ্দিনকে তিরস্কার করেনি। বলেছিল, আসল কাজই করতে পারলি না, শুধু শুধু দুর্নাম রটালি। গ্রেনেড হামলার পর মুফতি আব্দুস সালামের কাছে তাজউদ্দিন বলেছে, শেখ হাসিনা খুন না হওয়ায় ঘটনার সঙ্গে জড়িত উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী ও সরকার সংশিস্নষ্টরা মারাত্মক অসনত্মোষ প্রকাশ করেছেন। মারাত্মকভাবে তিরস্কার করা হয়েছে আমাকে। এ ভর্ৎসনা সহ্য করার মতো নয়। শুধু তাই নয়, ঘটনার সঙ্গে জড়িত বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার ওইসব কর্মকর্তাও তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন। এদিকে শেখ হাসিনা গ্রেনেড হামলায় বেঁচে যাওয়ায় দেশে তোলপাড় শুরম্ন হয়। ২০০৫ সালে সরকারের চাপের মুখে মুফতি হান্নান পাকিসত্মানে তৈরি আর্জেস ৮৪ মডেলের ১৬টি গ্রেনেড চায়নিজ কার্বাইন রাইফেল ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র গোলাবারম্নদসহ র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। এতে আরও ঝামেলা বেড়ে যায়। পরে ঝামেলা এড়াতে জড়িত গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাজউদ্দিনকে ওই বিশেষ গোয়েন্দা কার্যালয়েই বসবাসের ব্যবস্থা করেন। প্রয়োজনে তাজউদ্দিন ওই বিশেষ গোয়েন্দা কার্যালয়েই ৭/৮দিন করে থাকত। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ দিকে ২০০৬ সালে গ্রেনেড হামলায় জড়িত বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা তাজউদ্দিনকে পাকিসত্মান পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধানত্ম নেন। এ সময় মুফতি আব্দুস সালামকে ওই বিশেষ গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডেকে পাঠানো হয়। আব্দুস সালামকে তাজউদ্দিনের জন্য একটি পাসপোর্ট তৈরি করার দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু মুফতি আব্দুস সালাম এতে ঝামেলায় পড়ার আশঙ্কা করে। পরে গোয়েন্দা সংস্থার কতিপয় কর্মকর্তা নিজেরাই তাজউদ্দিনের পাসপোর্ট তৈরি করে নিজেরা বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে তাজউদ্দিনকে পাকিসত্মানে পাঠিয়ে দেন। একজন উর্ধতন গোয়েন্দা কর্মকর্তা পরবর্তীতে আব্দুস সালামকে বলেছে, আমি নিজে উপস্থিত থেকে তাজউদ্দিনকে বিমানে উঠিয়ে পাকিসত্মান পাঠিয়ে দিয়েছি।
মুফতি আব্দুস সালাম গোয়েন্দাদের জানায়, ২০০৪ সালের মার্চে হুজি প্রধান মুফতি হান্নান তার সঙ্গে মোহাম্মদপুরের ফাতেমাতুজ-জোহরার তার (মুফতি আব্দুস সালাম) নিজ মাদ্রাসায় দেখা করে। পরে দু'জনে সাত মসজিদের ভেতরে গোপন বৈঠকে বসে। জোহর নামাজের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের সাবেক উপমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ও পাকিসত্মানী নাগরিক মজিদ বাট ওই গোপন বৈঠকে যোগ দেয়। বৈঠকে তাজউদ্দিন বলেছিল, আগামীতে আওয়ামী লীগ ৰমতায় গেলে তাদের জন্য অসুবিধা হবে। আওয়ামী লীগ যাতে কোন দিনই ৰমতায় না আসতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার সরকারী সিদ্ধানত্ম হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা বেঁচে থাকলে আওয়ামী লীগ থাকবে। সেৰেত্রে আওয়ামী লীগ কোন না কোন সময় ৰমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে হবে। এতে বর্তমান (তৎকালীন) সরকারের পুরোপুরি সর্মথন আছে। এমনকি চূড়ানত্ম নির্দেশ পর্যনত্ম পাওয়া গেছে। শেখ হাসিনাকে হত্যার বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধানত্ম। এজন্য বর্তমান সরকার তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
এরপর মুফতি হান্নান, মুফতি আব্দুস সালাম ও মাওলানা তাজউদ্দিন একাধিকবার একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে বসে ওই গোয়েন্দা সংস্থারই কয়েকজন উর্ধতন কর্মকর্তার সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে। গোয়েন্দা সংস্থাটির কতিপয় উর্ধতন কর্মকর্তা শেখ হাসিনাকে হত্যার পূর্ণ সর্মথন দেয়। এ বিষয়ে পাকিসত্মানের মতামত জানতে এপ্রিল মাসে মুফতি আব্দুস সালাম পাকিসত্মানে যায়। আব্দুস সালামের পাকিসত্মানে যাতায়াতসহ যাবতীয় খরচ বহন করেছিল গোয়েন্দা সংস্থাটির ওইসব উর্ধতন কর্মকর্তা। আব্দুস সালাম পাকিসত্মানের লাহোর ও করাচীতে একাধিক বৈঠক করে। পাকিসত্মানে ৪ মাস ১২ দিন অবস্থানের পর সে বাংলাদেশে ফিরে। এই ফাঁকে মুফতি হান্নান, মাওলানা তাজউদ্দিন, হাফেজ তাহের (গ্রেফতারকৃত), হাফেজ তাহেরের বোনজামাই মাওলানা মনির, পাকিসত্মানী নাগরিক মজিদ বাট, জাহাঙ্গীর বদর, লস্কর-ই-তৈয়বার বাংলাদেশ শাখার প্রধান মাওলানা আবু জাফর ওরফে সাঈদ ওরফে আবু সাঈদ ওরফে হাফেজ সাঈদ, হুজির চীফ কমান্ডার মুফতি মইনুদ্দিন ওরফে আবু জান্দাল, আহসান উলস্নাহ কাজল, হাফেজ ইয়াহিয়া, জাহাঙ্গীর বদর ও মাওলানা আব্দুর রউফসহ প্রশিৰিত জঙ্গীরা একত্রিত হয়। প্রসঙ্গত, হাফেজ সাঈদের লাহোরে অফিস আছে। ১৯৯৮ সালে হুজিকে বিলুপ্ত ঘোষণার পর মাওলানা আব্দুর রউফ হুজি ত্যাগ করে আমির উদ্ দ্বীন নামে একটি নতুন দল গঠন করে। মাওলানা আব্দুর রউফ আমির উদ্ দ্বীনের আমির ছিলেন। বর্তমানে তিনি গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন।
শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য মোহাম্মদপুরের বাবর রোড়ের আল মারকাজুল ইসলাম, হুজি প্রধান মুফতি হান্নানের বাড্ডার অফিস, মুফতি হান্নানের বাসা, আব্দুস সালামের মোহাম্মদপুরের বাসা ও বিশেষ ওই গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে বহুবার গোপন বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি মাওলানা তাজউদ্দিন ভারতের কাশ্মীরে সক্রিয় জঙ্গী সংগঠনগুলোর মধ্যে লস্কর-ই-তৈয়বা, টিজেআই (তাহরিকুল জিহাদুল আল ইসলামী-কাশ্মীর, হরকাতুল মুজাহিদীন, হরকাতুল জিহাদুল ইসলামী, হেযবুল মুজাহিদীন, হেযবে ইসলামী, জমিউতুল মুজাহিদীন, হরকাতুল আনছার, জেকেএলএফ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। এসব জঙ্গী সংগঠনের ভারতের কাশী্মরে অফিস আছে। বৈঠক চলাকালে পাকিসত্মান থেকে প্রায় ২শ' গ্রেনেড আনা হয়। গ্রেফতারকৃত মজিদ বাট চট্টগ্রাম থেকে গ্রেনেডগুলো ঢাকায় নিয়ে আসে। এরপর মোহাম্মদপুরের বাড়িতে তাজউদ্দিনের কাছে গ্রেনেডগুলো হসত্মানত্মর করে মজিদ বাট। এর মধ্যে প্রায় ১শ' গ্রেনেড তাজউদ্দিন নিজের কাছে রাখে। বাকিগুলো ভারতের কাশ্মীর মুজাহিদদের কাছে হসত্মানত্মর করে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যনত্ম র্যাবই ৭৩ আর্জেস গ্রেনেড উদ্ধার করে। এছাড়া ডিবি পুলিশও বেশ কিছু আর্জেস গ্রেনেড উদ্ধার করে। উদ্ধারকৃত গ্রেনেডগুলো ৮৪ মডেলের। এসব গ্রেনেড পাকিসত্মানের তৈরি। মুফতি আব্দুস সালাম বলেছে, পাকিসত্মানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বাংলাদেশ থেকে ভারতের ভেতরে বিভিন্ন নাশকতামূলক কার্যক্রম চালায়। এসব নাশকতার রসদের যোগান দেয় পাকিসত্মানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই।
বেশ কয়েকটি গোপন বৈঠকে মুফতি হান্নানের সঙ্গে পাকিসত্মানের জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল মুজাহিদীনের নেতা পাকিসত্মানের পাঞ্জাব প্রদেশের বাসিন্দা মাওলানা ফজলুর রহমান খলিলও উপস্থিত ছিলেন। বর্তমানে খলিল পাকিসত্মানেই রয়েছে। সর্বশেষ চূড়ানত্ম বৈঠক হয় হাওয়া ভবনে। হাওয়া ভবনের ওই বিশেষ বৈঠকে বর্তমানে নানা কারণে জামায়াত-শিবিরের কাছেই বিতর্কিত জামায়াতের কেন্দ্রীয় সেই নেতাও উপস্থিত ছিলেন। তারপরই ইতিহাসের সেই জঘন্যতম গ্রেনেড হামলা চালানো হয়।

No comments

Powered by Blogger.