চরাচর-বিজয়পুরের মৃৎশিল্প by আনন্দ কুমার ভৌমিক

বিজয়পুর। কুমিল্লা শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে। এখানকার সাতটি গ্রামে রুদ্রপালদের বসবাস। বংশপরম্পরায় তারা তৈরি করে মাটির হাঁড়ি-পাতিল, গ্লাস, থালাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র, যা বিক্রি করে তারা নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করত।
একটা সময় ব্রাহ্মণ রাজা রাজনারায়ণ চৌধুরীর পালদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। এতে স্থানীয় 'শিবের বাজার'-এ পালদের তৈরি জিনিসপত্রের বিপণনের সুযোগ ঘটে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পালদের তৈরি এসব জিনিস রান্নাঘর থেকে নিজেদের অধিকারটুকু হারাতে বসে। সেই সঙ্গে ঘটে তাদের ভাগ্যবিপর্যয়। তবে থেমে থাকেনি তাদের জাত ব্যবসার ঐতিহ্য রক্ষার যুদ্ধ। ১৯৫০ সালের প্রথমদিকে স্থানীয় পাল যুবকরা একত্রিত হয়ে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট হয়। তারা ১৯৬১ সালে সংগঠিত হয়ে গড়ে তোলে সমিতি। এতে তাদের দিন কিছুটা হলেও ফিরছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় ধ্বংস হয় সব কিছু।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যখন কুমিল্লায় আসেন, তখন সংগঠনটি 'ইন্দিরা-মুজিব' ছবিসংবলিত দিনপঞ্জিকার অনুকরণে একটি ভাস্কর্য বঙ্গবন্ধুকে উপহার হিসেবে প্রদান করে। প্রতিষ্ঠানটি পুনর্বাসনের জন্য তৎকালীন সরকার ৭৫ হাজার টাকা অনুদান দেয়। ফলে আবারও নিজের অধিকার ফিরে পেল বিজয়পুরের মৃৎশিল্প। তবে এবার একটু ভিন্নভাবে। রান্নাঘরের পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে বসার ঘর, শোবার ঘর, পুরো বাড়ির বিভিন্ন সজ্জা থেকে অফিস পর্যন্ত সবখানেই সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে মাটির তৈরি বিভিন্ন জিনিসের পর্যাপ্ত ব্যবহার হতে থাকল। এক সময় রান্নাঘরে নারীদের দায়িত্বশীল হাতে ব্যবহৃত হচ্ছে মৃৎশিল্প। কিন্তু এখন নারীদের অঙ্গসজ্জাতেও মাটির গয়নার সম্মানজনক ব্যবহার শুরু হলো। তিন হাজারেরও বেশি রকমের উপকরণ তৈরি করে বিজয়পুরের মৃৎশিল্প। যার মধ্যে রয়েছে রকমারি ফুলদানি, কলমদানি, ওয়ালম্যাট, গাছের টব, ল্যাম্পস্ট্যান্ড, পুতুল, বিখ্যাত ব্যক্তিদের মুখাবয়ব, পশু, পাখি, ফুল, ফল, গাছ, গ্রামের দৃশ্য, বিভিন্ন রকমের ব্যাংক, ধর্মীয় মূর্তি, ভাস্কর্য, ট্রে, শিশুদের খেলনার সরঞ্জাম, রঙিন হাঁড়ি-পাতিল, গয়না ইত্যাদি। এগুলোয় রয়েছে বিভিন্ন রঙের ব্যবহার। দৃষ্টিনন্দন এসব জিনিসপত্র যে কারো মন কাড়ে। বিজয়পুরের মাটিকে প্রথমে আধুনিক পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে শিল্প সৃষ্টির উপযোগী করা হয়। শিল্পীরা আধুনিক যন্ত্রপাতি ও নিজেদের সৃজনশীলতার সমন্বয়ে সৃষ্টি করে কাঁচা মাটির জিনিস। এরপর শুকানো হয়। শুকানোর পর তিনটি আধুনিক চুল্লিতে ভিন্ন তাপমাত্রায় পোড়ানো হয়। তারপর প্রয়োজনে রং করা, আবার পোড়ানো হয়। সবশেষে দৃষ্টিনন্দন এক অসাধারণ প্রাপ্তি।

No comments

Powered by Blogger.