শিবির যেভাবে বাবাকে হত্যা করে by শোভন

এ দিনটি আমার পরিবারের রায় বদলের দিন। পরিবারটির পুরো অস্তিত্ব মুছে যাবার দিন। বাবা বলতেন বাড়ির নাম রাখব ভাই-বোন। ছোট বোন সারা সুদীপা আর আমি, এ নিয়ে খুব হাসাহাসি করতাম।
দু'ভাই বোন বাবার সঙ্গে খুব আনন্দ করতে পারতাম। তিনি এটা খুব পছন্দ করতেন। বিজয়ের মাসে চলে গেলেন তিনি। '৭১ থেকে '০৪ এ দীর্ঘ সময়ে এই স্বাধীন দেশেও তাঁকে বেশ কবার হামলার শিকার হতে হয়েছে। মাকে চরম উৎকণ্ঠার সঙ্গে কাটাতে হয়েছে অনেক রাত। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য অনেক শিকের মতো আমাদের অবস্থা ছিল না। ঠিক একাত্তরের পরে বাবা প্রতিমুহূর্তই প্রচ- ব্যসত্মতা নিয়ে কাটাতেন। আমি আমার মা_ দু'জনেই বাবাকে খুব কম সময়ই কাছে পেতাম। বাবার রাজনীতি ছিল স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরম্নদ্ধে। অনেক স্মৃতি সব সময়েই চোখের সামনে ভাসে।
বিজয়ের মাসে কাকডাকা ভোরে ছোট শোভনকে ডেকে তুলতেন তিনি। কুয়াশা আদরের চাদরে ঢেকে রাখত চারদিক। আম্মা হাতে বোনা ফুলসোয়েটার পরিয়ে লম্বা চুলে মাঝসিঁথি করে দিতেন। বাবার তখন খুব জাঁদরেল চেহারা। ঢেউ খেলানো লম্বা চুল, বিশাল জুলফি, ইয়া গোঁফ। একাত্তরপরবতর্ী মানুষের চেহারাই ছিল অন্যরকম। সবার চেহারাতে যুদ্ধফেরত দুর্ধর্ষতা প্রকাশ পেত। শিক কি ছাত্র সবাই একটা সুন্দর স্বপ্নের বাসত্মবায়ন নিয়ে ভাবতেন। বাবার একটা আঙ্গুল ধরে টুকটুক পায়ে মতিহার হলের মাঝামাঝি ফুলের বাগান থেকে ফুল হাতে প্যারিস রোডে এসে উঠি। সিক্ত শহীদ মিনারকে পাশ কাটিয়ে প্যারিস রোডের শেষ মাথায় শিক-কাবের প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়াতাম। সকল শিক সামনে মালা নিয়ে ধীরগতিতে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে গিয়ে শহীদ মিনারে শহীদদের সম্মান জানিয়ে নীরবতা, সংপ্তি বক্তব্য শেষে বিজয় দিবস উদ্যাপন শুরম্ন করতেন। ২০০৪-এর এ দিনটিতে বাবা একইভাবে বিজয় দিবসের সূচনা করলেন এবং ২৪ তারিখে নির্মমভাবে নিহত হলেন। প্রতিটি দিন চোখের সামনে ভাসে। এত বড় বন্ধু, এত বড় সুহৃদ সবার প্রতি তাঁর ভালবাসা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। দেশের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় ভালবাসা দেখে আমি সব সময়ই মুগ্ধ হতাম। সেই ছোট্টবেলা থেকে প্রতিটি জাতীয় দিবসে তিনি আমাকে নিয়ে যেতেন এবং দিবসগুলোর গুরম্নত্ব বোঝাতেন। অন্য সবার সঙ্গে তাঁর পার্থক্যও বুঝতে পারতাম। নিভর্ীকতার প্রতিমূর্তি আমার বাবা মোহাম্মদ ইউনুস।
খুব ছোটবেলার একটা ঘটনা চোখের সামনে ভাসে। স্কুল থেকে ফিরছি। প্রশাসন ভবনের পশ্চিম দিক থেকে প্যারিস রোড ধরে আসছি। ১৯৮১-৮২ সালের ঘটনা। রাসত্মাগুলো মিছিলে মিছিলে সয়লাব। আমি স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রায়ই আব্বার অফিস হয়ে ফিরি। এটা-সেটা কিনে দেন। সেদিন অফিসে গিয়ে বাবাকে পাইনি। ওদিকে রাসত্মায় দেখি ছাত্রদের একাংশ ফুঁসছে। গর্জাচ্ছে, তীব্র সেস্নাগানে একাকার। এসব দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ দেখি বাবাকে। প্রশাসন ভবনের সামনে একা_সম্পূর্ণ একা, কিছুটা উদ্ভ্রানত্ম। এদিক সেদিক থেকে ঢিল পড়ছে। বাবা কিছু ছাত্রকে ঈশারায় পিছিয়ে যাবার নির্দেশ দিচ্ছেন। ঠিক ঐ সময়ই ছাত্রশিবিরের একটা গ্রম্নপ লাঠি মিছিলসহ বেরিয়ে এসেছে, জনা ৫০ হবে। পূর্বদিক থেকে ড. জোহার চত্বরকে বামদিক থেকে পাশ কাটাচ্ছে। এদিকে হঠাৎই প্রশাসনের পশ্চিমে থাকা ছাত্রমৈত্রী এবং অন্যান্য সংগঠনের ছাত্ররা ধাওয়া করল শিবিরের মিছিলকে। ছাত্রশিবিরের ছাত্ররা সবাই দৌড় দিল মেইন গেটের দিকে। বাবা চিৎকার করছেন। ছাত্রদের পিছিয়ে যাবার নির্দেশ দিচ্ছেন। প্রশাসন ভবনের জানালা দিয়ে তৎকালীন রেজিস্ট্রার ওমর ফারম্নক চিৎকার করছেন ইউনুস তুমি ভেতরে আস। আমি এর মধ্য দিয়ে এদিকে সেদিক পাশ কাটিয়ে কোন মতে বাড়ি ফিরি। পরে শুনি মেইন গেটের আগে বিএনসিসির সামনে দু'জন ছাত্রশিবির কমর্ী নিহত হয়েছে। অনেক পরে জানতে পারি, ঐ হত্যা দু'টির জন্য তারা বাবাকে দায়ী করত। যখন কলেজে পড়ি তখন ছাত্রশিবির আয়োজিত একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী হয়েছিল বেগম রোকেয়া হলের সামনের চত্বরে। কি মনে হলো দেখতে ঢুকলাম, ঘুরতে ঘুরতে ৮১-৮২'র ঘটনাও পড়লাম এবং শিউরে উঠলাম সেখানে বাবার নাম দেখে। তারা সম্ভাব্য খুনী মনে করে আমার বাবা মোহাম্মদ ইউনুসকে। এর পর থেকেই একটু সিটিয়ে থাকতাম। বাবাকেও ঘটনাটা বললাম, বাবা বললেন ওরা অনেক ভুল ধারণা নিয়ে পথ চলে_ কি করা যাবে।
৯৫ সালের ৩০ নবেম্বর। ভার্সিটির পরিস্থিতি ভাল না। ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে কতর্ৃপ সিন্ডিকেটের মিটিংয়ে বসেছে। তৎকালীন ভিসি ইউসুফ আলী, রসায়ন বিভাগ। জামায়াতের আশীর্বাদপুষ্ট ভিসি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াত শিবিরকে প্রতিষ্ঠার পেছনে আরেক শিকের বিশাল ভূমিকা আছে। তিনি হলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর আব্দুর রহমান সিদ্দীকি। আমি টিএসসিসি-এর প্রশিক হিসেবে এডহক ভিত্তিতে কাজ করতাম। পরবতর্ীতে তিনি টিএসসিসি-এর পরিচালক হন এবং তাঁর মুখ থেকেই শুনেছি তিনি কিভাবে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন এবং পরবতর্ীতে মতের মিল না হওয়ায় শিবিরই তাঁর বাড়িতে হামলা করে। যাই হোক' '৯৫-এর ৩০ নবেম্বর সিদ্ধানত্ম হয় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকবে। সবাইকে হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। বাবা আর মনোবিজ্ঞানের শিক মুঈদ সাহেব রিকশাযোগে বাড়ি ফিরছিলেন। ছাত্রশিবিরের কতিপয় ছাত্র মসজিদের সামনে থেকে বাবাকে জোর করে নামিয়ে শারীরিকভাবে আঘাত করে। সবার মুখ বাঁধা ছিল, রাত তখন ৯টা। অপর শিকটি রিকশা নিয়ে সেখান থেকে চলে যান প্রাণের তাগিদেই। বাবা সেখান থেকে একাই হেঁটে বাড়ি ফিরলেন। ঠিক তখন থেকেই সমগ্র অসত্মিত্বে একটা তীব্র আতঙ্ক ছড়াল। বুঝতে পারলাম, ওরা তো বাবাকে ছাড়বে না। এর পরও বাবা কিছুই পরোয়া করতেন না। একবার বাসায় বোমা ফেলল। অনেক দিন পুলিশ পাহারা থাকল বাসায়। ছোট থেকেই এসব দেখে একেবারে অভ্যসত্ম হয়ে গিয়েছিলাম। আম্মা চরম আতঙ্ক আর দুশ্চিনত্মা নিয়ে দিন কাটাতেন। অন্যান্য সবার মতো তিনি বিকেল বেলা কিংবা কোন উৎসবে যোগ দিতেন না। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২য় বর্ষের ছাত্র। এসব ঘটনার পরে বাবা যখন শিক কাবে যেতেন, তার সঙ্গে সঙ্গে যেতাম, পেঁৗছে দিয়ে বাবা চলে যেতে বলতেন। মন মানত না। শিক কাবের সামনে পুকুরঘাটে একা বসে থাকতাম। ১০টার দিকে বের হলে তাঁর পিছু পিছু ফিরতাম।
আমি বাবার কাজকর্ম খুব কাছ থেকে দেখতাম। তাই জানতাম বাবা জামায়াত-শিবিরের জন্য কত বড় একটা বাধা। শিবিরের হাতে আহত হবার পর সবাই তাঁকে নিষেধ করে কিন্তু তিনি ছাত্রশিবিরের নামেই মামলা করেন। 'বাবু' নামের একজন শিবিরকমর্ী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মচারীর ছেলে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রহরীর চাকরিরত। আমার বাবাকে '৯৫ সালে আহত করার সঙ্গে জড়িত_ অনেক পরে জানতে পারি। তার কিছুই হয়নি। তারা বহাল তবিয়তেই আছে। এ কারণেই আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। আমার বাবা মোহাম্মদ ইউনুস বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য যে কোন শিকের চেয়ে সাহসী ভূমিকা পালন করতেন, এ জন্যই তাকে হত্যা করা হয়। রায় হয়েছে ২ জনের ফাঁসি। বাকি ছয়জন ছাড়া পেয়েছে। বাকি ছয়জনও জড়িত ছিল। তারা কিভাবে ছাড়া পায়? তাহের স্যারের মূল আসামিও ছাড়া পেয়েছে। তাহলে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়?
ঘুম ভাঙল পাড়ার এক মহিলার চিৎকারে। বাবা রাসত্মার পাশে পড়ে আছেন। বাসা থেকে বেরিয়ে ঘটনাস্থলে পেঁৗছলাম। তাঁর কাছে পেঁৗছানোর আগেই বুঝলাম বাবা নেই। আমার সমগ্র অসত্মিত্বের মৃতু্য হলো। বেশ ক'জন শিক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমাকে ধরলেন ইতিহাসের ড. ওয়াজেদ আলী। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল তারা আমাকে বোঝাচ্ছিলেন, এটা একটা এক্সিডেন্ট, ট্রাক কিংবা কোন গাড়ি বাবাকে চাপা দিয়েছে। তারা কেউ ভয়ে বলতে পারছিলেন না_ এটা একটা হত্যাকা-। একটু ফিরে যাওয়ার পর খেয়াল হলো, আমার মা আর বোন ঢাকায়। বোনকে টেলিফোন করে বললাম, তুমি আম্মাকে নিয়ে আস, কিন্তু তাকে কিছু বুঝতে দিও না। আমার ছোট বোন মাকে সারা রাসত্মা এটা সেটা বুঝিয়ে নিয়ে আসে। এক ফোটা চোখের পানি ফেলতে পারেননি। দুপুরে নয়াদিগনত্মের সাংবাদিক সরদার আনিসুর রহমান ঝামেলা করার চেষ্টা করলেন। বাসার বিভিন্ন মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন; পারিবারিক দ্বন্দ্ব ছিল কিনা, ছেলের সঙ্গে বাবার গোলমাল ছিল কিনা। বাসার কাজের লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কোনভাবে আমাকে ফাঁসানো যায় কিনা তার চেষ্টা। সরদার আনিসুর রহমানের কল্যাণে আমি ভাল বিপদেই পড়ি। তিনি বাবার সঙ্গে ছেলের দ্বন্দ্বের কারণে এই মৃতু্য_ এ রকম সংবাদ প্রকাশ করেন। আমার মাথা কাজ করছিল না। ২৪ তারিখ পার হতে না হতে ২৬ তারিখে তৎকালীন ছাত্রশিবিরের সভাপতি (বিশ্ববিদ্যালয় শাখার) আমাকে ডেকে পাঠালেন। বুলবুল নামের একজন কমর্ী বিনোদপুর বাড়ি, সে আমাকে মোটরসাইকেলে করে বঙ্গবন্ধু হলের এক রম্নমে নিয়ে গেল। তারা আমাকে বোঝালেন, কিভাবে আমি নিরাপদে থাকতে পারব। এই হত্যাকা-ের সঙ্গে ছাত্রশিবিরের কোন সংশিস্নষ্টতা নেই। সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এটাই আমাকে ঘোষণা করার জন্য বললেন। কোনভাবে সেখান থেকে বেরিয়ে আসলাম। এরপর বিনোদপুর মতিহার থানা সভাপতি মাসুক আমাকে একই কথা বললেন। একেবারে দিশেহারা হয়ে গেলাম। বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে আমাকে বলা হলো, নিজেকে বাঁচাতে হলে সাংবাদিকদের কাছে আমি যেন বলি, এ হত্যাকা-ের সঙ্গে শিবিরের কোন সংশিস্নষ্টতা নেই। এর সঙ্গে চলছে সরদার আনিসুরের নয়াদিগনত্মে আমার বিরম্নদ্ধে বিষোদগার। এর ওপর তৎকালীন প্রশাসনের ওসি আকরামের জিজ্ঞাসাবাদ। সারারাত ধরে জিজ্ঞাসাবাদ। এ অত্যাচারের বর্ণনার কোন ভাষা নেই। সবাই নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিল। কেউ ঠিকমতো কথা বলত না। বাবার মৃতু্যর জন্য তৎকালীন প্রশাসন বার বার আমার দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করছিল। মা একেবারে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। আমি অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। শারীরিক এবং মানসিক উভয় দিক থেকেই। বাবার মৃতু্যর প্রায় দেড় বছর পর অপরাধীরা ধরা পড়ে, স্বীকারোক্তি দেয়। এই দেড় বছরে আমি একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছিলাম। মা ঢাকায় চলে গিয়েছেন একরকম ভয়েই। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটাও স্থায়ী করা হয়নি।
২০০৪ থেকে এখন ২০১০। রায় হলো গত মাসের ২৮ তারিখে। ২ জনের ফাঁসি, ছ'জন বেকসুর খালাস(!)। আমরা কোন পয়সা খরচ করতে পারিনি। এ জন্যই বাকি ছয়জন খালাস পেয়েছে। পুলিশ নাকি কিছুই প্রমাণ করতে পারেনি। কাকে বলব? নেত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনী ইশতিহারে আমার বাবার হত্যার বিচারের কথা বলেছিলেন। সঠিক বিচার তো হলো না! বাবার শখের একতলা বাড়িটিও বিক্রি করে দিয়েছেন মা। মা ঐ বাসায় যেতে চান না। তাঁর খুব কষ্ট হয়। মাকে একটু ভাল রাখতে পারলে আর কিছুই চাওয়ার ছিল না।
লেখক : অধ্যাপক ইউনুসের ছেলে

No comments

Powered by Blogger.