অভিমত ॥ পদ্মা সেতু এবং আমাদের রাজনীতি by সামছুল করিম

আমার অনুমানের ভিত্তি হিসেবে বলতে পারি : বিশ্বব্যাংক নাম হলেও এর প্রধান টাকার উৎস আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডা এবং পশ্চিম ইউরোপের টাকার ব্যাংক সুদ বার্ষিক গড়পড়তায় বড়জোর দুই টাকা।
আমেরিকার সঙ্গে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড এত এত টাকা ব্যাংকে ফেলে না রেখে প্রায় একই রকম সুদে এই টাকা লগ্নি করে তাদের কিছু শর্ত এবং উদ্দেশ্য হাসিলের সাথে শরিক বা উন্নয়নমুখী দেশকে কোন কোন খাতে সুদে টাকার যোগান দেয়। আমেরিকার এক নম্বর নজর হলো অস্ত্র বিক্রি। কাপড়চোপড় বা অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর তুলনামূলক মূল্য নির্ধারণ করা যায়। কিন্তু অস্ত্র বা তেজস্ক্রিয় পণ্য প্রস্তুতকারী দেশ যে মূল্য নির্ধারণ করে ব্যবহারকারীরা তা নিয়ে দর কষাকষি করতে পারে না। বিশেষ করে যারা অবৈধ কাজে ব্যবহার করার জন্য বা চোরাইপথে কেনে এবং পাচার করে তাদের তো দর কষাকষির সুযোগই আসে না।
আওয়ামী লীগ ১৪ দলের মহাজোট করে ক্ষমতায় আসার পর দেশের অনেক ক্ষেত্রেই উন্নতি করেছে। কিন্তু তার নির্বাচনী ইশতেহারে যে প্রধান একটি ওয়াদা ছিল এবং সেজন্য বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি রেকর্ডসংখ্যক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করেছে। সেই ’৭১ সালের স্বাধীনাতবিরোধী এবং মানবতাবিরোধী কর্মকা-ের কা-ারিদের যখন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে তখন বিএনপি ও জামায়াতের বন্ধুদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমেরিকা বলেছিল বিচার সুষ্ঠু হওয়া চাই। অর্থাৎ বিচার আমাদের মতে সুষ্ঠু হওয়া চাই অথবা বিচারের রায় আমাদের পছন্দ নাও হতে পারে। এখন যখন রায়ের অপেক্ষায় আছে তখন জামায়াত তো মাঠে আছাড়-পাছাড় খাচ্ছে তাদের সঙ্গে বিএনপিরও কম্য আছে। এখন পদ্মা সেতুর বিশ্বব্যাংকের ঋণের ব্যাপারে এলেন গোল্ডস্টেইনের সুর চড়া হচ্ছে। যার প্রমাণ ডিসেম্বরের শুরুতে তার সংবাদ সম্মেলন। আবার এদিকে জামায়াতের ডলার ও লবিং এবং আমেরিকার উপদেশ গ্রহণ করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল প্রথমে এনজিও কর্মীর আবরণে গুপ্তচর পাঠান। ধরা পড়ার পর সাপের ফণার মতো এক চিঠি পাঠালেন গোলাম আযমদের ফাঁসি না দেওয়ার জন্য। আরও কত উপদেশ আসবে আমেরিকার হাতের পুতুল ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কের ধর্মীয় মৌলবাদী আবদুল্লাহ গুল কিভাবে জানতে পারলেন যে, তাদের মৃত্যুদ- দেওয়া হবে রায় ঘোষণার অনেক আগে।
এখন আসছে পদ্মা সেতুর কথা। পদ্মা সেতুর ব্যাপারে যা হয়েছে মোদ্দাকথা ঘুষ লেনদেনের প্রস্তাব হয়েছে টাকা বা ডলার লেন দেন হয়নি। যেহেতু প্রস্তাবিত অর্থ যোগান দেওয়া হয়নি। এর আগে জোট সরকারের আমলে পদ্মা সেতু নিয়ে বহু নাটক হয়েছে। জাপানী উন্নয়ন সংস্থা জাইকা ডলার ট্রান্সফার করে বাংলাদেশে নিয়ে আসছিল। শরীয়তপুর, মাদারীপুর বা বৃহত্তর ফরিদপুর, খুলনা, বাগেরহাটে উন্নতির কথা ভাবলে খালেদা জিয়ার দাহজ্বালা শুরু হয়। কেন না এসব জায়গায় তার ভোট কম। তিনি মাগুরায় উস্কানি দিয়ে আন্দোলন করালেন যে, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় সেতু হবে মাওয়ায় না। সে এক তুমুল আন্দোলন। জাইকার কাছে কোন নির্দিষ্ট নকশা বা প্ল্যানই দেখাতে পারেননি।
প্রধানমন্ত্রী হয়ত এসব অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন এবং ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে বিশ্বব্যাংক ব্যতীত আরও তিন দাতা জাইকা, এডিবি ও ইসলামী ব্যাংকের সাহায্য এবং নিজেরা টাকা দিয়ে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করার কল্পনা করেছিলেন। অথবা তারা না এলে নিজেদের টাকায় সেতু নির্মাণ হতো। আরেকটা অপশন রেখেছিলেন মালয়েশিয়ার অর্থায়ন। অনেকের মতে, এগুলোই আসল রাস্তা ছিল। দু’এক ক্ষেত্রে ভর্তুকি না দিয়ে বা দু’চারটা রাস্তা বা ফ্লাইওভার বাদ দিয়েও যদি এ সরকারের শেষ বছরের ৮/৯ মাসও সেতুর কাজ হতো তখন নেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়প্রত্যয় দেখে মানুষ মুগ্ধ হতো এবং পুনরায় সদলবলে নির্বাচিত করত। তার বাধা সৃষ্টি করল আমাদের বহুকাল বিলেত প্রবাসী অর্থমন্ত্রী। তার দেশ নামক সংসার বা বাজেট ঠিক রাখার স্বার্থে বিশ্ব ব্যাংকের কাছে ধরনা দিয়ে খালি হাতে মন্ত্রী ও অর্থনীতিবিদ হিসেবে নিজের ও সরকারের ভবিষ্যত অন্ধকার করলেন কি না ভেবে দেখবেন।

No comments

Powered by Blogger.