আওয়ামী লীগের তৃণমূলে ৰোভের মূলে আত্মীয়স্বজন by মামুন-অর-রশিদ

যাদের নিয়ে,যাদের জন্য রাজনীতি তৃণমূলের সেই নেতাকর্মীরা স্থানীয় পর্যায়ে ৰমতাসীন দলের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেছেন আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায়। তাঁরা মন্ত্রী-এমপিদের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি।
স্থানীয় পর্যায়ে দলের এই সঙ্কট নিরসন না করা হলে ভবিষ্যতে দলকে মারাত্মক খেসারত দিতে হবে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তাঁরা। দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্মীদের নানান অভিযোগ, হতাশা এবং প্রত্যাশা-প্রাপ্তির ব্যবধানের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। তিনি তৃণমূলের কর্মীদের দলের প্রাণ অভিহিত করে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। বর্ধিত সভায় তৃণমূল কর্মীদের দেয়া সবচেয়ে গুরম্নত্বপূর্ণ মেসেজ হচ্ছে_ স্থানীয় পর্যায়ে এমপি-মন্ত্রীদের ভাই, ভাতিজা আর আত্মীয়স্বজন ছাড়া তৃণমূলের দলীয় নেতাকর্মীরা ৰমতাসীনদের কাছে ভোগ পাচ্ছেন না। এতেই দলের নেতাকর্মীরা ৰুব্ধ-হতাশ। অন্যদিকে স্থানীয় পর্যায়ে দলের অভ্যনত্মরীণ কোন্দলে ৰমতাধর গ্রম্নপ দলীয় প্রতিপৰ গ্রম্নপকে নির্মূলে নানা কূটকৌশলের বিষয় সভায় তুলে ধরা হয়। সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিসত্মারিত জানার পর প্রধানমন্ত্রী প্রতি শনিবার জেলা-উপজেলা পর্যায়ে নেতাদের ডেকে ঢাকায় নিয়ে এসে দলের সমস্যা-সম্ভাবনার বিষয় জানার কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সমসাময়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে সজাগ থাকাসহ বিভিন্ন বিষয়ে গাইডলাইন দিয়েছেন। বিশেষ করে কেউ যাতে মানুষের সামনে নিজেদের ৰমতাসীন ভাব না দেখায়। তাহলে বিএনপি-জামায়াতের পরিণতি বরণ করতে হবে বলে তিনি মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সতর্ক করে দেন। একই সঙ্গে তিনি সুযোগসন্ধানীদের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকার জন্য বলেছেন।
সারাদেশে মাঠ পর্যায়ে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাদের নিবিড় সম্পর্ক ধরে রাখতে আয়োজন করা হয় আওয়ামী লীগের এই বর্ধিত সভা। শনিবার দিনভর বর্ধিত সভায় গণভবনে সারাদেশ থেকে কয়েক হাজার তৃণমূল নেতাকর্মী অংশ নেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধৈর্য ধরে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বক্তব্য শোনেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাত সাংগঠনিক সম্পাদকের সঙ্গে বর্ধিত সভা উপলৰে বৈঠকে মিলিত হন। প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন যমুনায় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বর্ধিত সভার মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াতের নানা ষড়যন্ত্র রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় তৃণমূলে দলকে শক্তিশালী করার কাজে হাত দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালের নির্বাচনী অভিজ্ঞতা থেকেই আওয়ামী লীগ তৃণমূলে দল সংগঠিত করার কাজে হাত দিয়েছে।
২০০১ সালের অক্টোবর নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সারাদেশে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির নির্দেশক হিসেবে কাজ করছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যনত্ম ৰমতায় থাকাকালীন সংগঠনের দিকে বেশি নজর দেয়া হয়নি। যে কারণে ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনে সারাদেশে ভোট কারচুপির লৰ্যে পরিচালিত স্থ্থূূল কারচুপির বিরম্নদ্ধে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। এই বর্ধিত সভার মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে দলের সার্বিক পরিস্থিতি, স্থানীয় পর্যায়ে উপদলীয় কোন্দল, দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীদের অনাচার-দুরাচার, আত্মীয় ও পারিবারিকীকরণ চিত্র, সৃষ্ট বিরোধ নিরসন কৌশল, দীর্ঘদিন দলের পরীৰিত, পোড়খাওয়া নেতাকর্মীদের অনেকের হঠাৎ নিস্ক্রিয়তা চিত্র তুলে ধরা হয়। দল ৰমতায় থাকলে ৰমতাধরদের আত্মীয়পরিজন আর তোষামোদকারীদের ভিড়ে ত্যাগী-পোড়খাওয়া কর্মীরা নিস্ক্রিয় হয়ে যান এবং রাজনীতির মাঠ ছেড়ে যান। এই অবস্থা ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মোকাবেলা করেছে। এমনকি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপিও টের পেয়েছে। দল ৰমতায় থাকতে যারা ফ্রন্ট লাইনে থাকেন তাদের অনেকেই দুর্দিনে উধাও হয়ে যান। এরা দলের জন্য সবচেয়ে ৰতিকর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্ধিত সভার বক্তব্যে এ জাতীয় সুযোগসন্ধানীদের ব্যাপারে দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সজাগ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
তৃণমূল কর্মীদের জিজ্ঞাসা
বর্ধিত সভায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দল নিয়ন্ত্রণ করবেন নাকি দল তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে। এ ব্যাপারে তারা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধানত্ম চেয়েছেন। তারা স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীদের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, অনেকে মনে করছেন ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। তাদের নৌকা প্রতীক ছেড়ে দিয়ে নির্বাচনে জয়ী হতে পারেন কিনা, তা পরীৰা করে দেখার জন্য বলেছেন। বিশেষ করে এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়করণ,পারিবারিকীকরণ এবং নিজস্ব প্রভাব বলয় তৈরি স্থানীয় পর্যায়ে দল মারাত্মক সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে বলে তৃণমূল নেতাকর্মীরা দলীয় সভানেত্রীকে জানিয়েছেন। তারা মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটি বাতিল করে নতুন কাউন্সিলে দলীয় স্থানীয় পর্যায়ে কমিটি গঠনের দাবি জানান। তারা দলের সঙ্গে সরকারের সামগ্রিক সমন্বয়হীনতার অভিযোগ আনেন। বিএনপি-জামায়াত জোটের পাঁচ বছর এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু'বছর মিলিয়ে গত সাত বছর দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের যারা জেল-জুলুম-হুলিয়া সহ্য করেছে, মৃতু্যভয় উপেৰা করে দলের জন্য কাজ করেছে; আজ কেউ তাদের খোঁজ নিচ্ছে না। খোঁজ নেয়া দূরের কথা, তারা ৰমতাধর এমপি-মন্ত্রীদের সাৰাত পর্যনত্ম পাচ্ছেন না। সে কারণে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ৰোভ বিৰোভে রূপ নিতে পারে, যা আগামী নির্বাচনে বড় ধরনের বিপর্যয়ের শঙ্কা তৈরি করছে। এদিকে উপজেলা পরিষদে নির্বাচিত দলীয় চেয়ারম্যানরা তাদের কার্যৰমতা বাড়ানো এবং স্থানীয় পর্যায়ে ত্রিমাত্রিক বিরোধ নিরসনের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী তাদের দাবির প্রেৰিতে বলেছেন, অনেক কাজ হবে। কাজ করে শেষ করতে পারবেন না। তিনি সকলকে একটু ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রীর অভিব্যক্তি ও নির্দেশনা
তৃণমূলের এক নেতা তার বক্তব্যে বলেন, দল ৰমতায় আসার এক বছরেও ৰমতার স্বাদ পাননি। প্রধানমন্ত্রী এই বক্তব্যে খুশি হয়ে বলেন, এটাই হওয়া উচিত। রাজনীতি ৰমতা ভোগের জন্য নয়, জনগণের সেবার জন্য- এমন অভিমত ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ৰমতায় আছে এমনভাব তৃণমূলের নেতাকর্মীরা যত কম দেখাবে দলের জন্য ততই মঙ্গল। ৰমতায় আছি ভাব দেখালে বিএনপি-জামায়াতের পরিণতি বরণ করতে হবে বলে তিনি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের জানিয়ে দেন। বর্ধিত সভায় এমপি-মন্ত্রীদের কোন রকম বক্তব্যের সুযোগ না দিয়ে তিনি শুধু তৃণমূলের বক্তব্য শোনেন। বর্ধিত সভার কর্মঅধিবেশন তিনি নিজেই পরিচালনা করেন। প্রাণ খুলে যাতে তৃণমূলের নেতারা প্রধানমন্ত্রীকে সব জানাতে পারেন সেই লৰ্যে তিনি অনত্মত প্রতি শনিবার জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের ঢাকায় ডেকে কথা বলবেন।
তৃণমূল নেতাকর্মীদের দলের প্রাণ অভিহিত করে শেখ হাসিনা বলেন, দলের সাংগঠনিক শক্তি যত দৃঢ় হবে সরকারের কর্মসূচী ততই সফল হবে। বিশেষভাবে উলেস্নখ্য, এক এগারোর পরে দলের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক নেতা কথিত সংস্কারের পথে গিয়ে দলীয় সভানেত্রীর বিরম্নদ্ধে অবস্থান নেয়। ২০০৮ সালের বর্ধিত সভায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে ছাড়া কোন সংলাপ নয়, নয় কোন নির্বাচন। তখন বর্ধিত সভায় দলীয় সভানেত্রীর চেয়ারটা খালি রাখা হয়। সেখানে কেউ না বসে শেখ হাসিনার প্রতি নিরঙ্কুশ আস্থা জানিয়েছে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তাই শেখ হাসিনা দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের দলের প্রাণশক্তি বলে অভিহিত করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.