মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি-নিবন্ধনের প্রথম দিনেই ঢাকা ও বরিশালে চরম ভোগান্তি

সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির লক্ষ্যে ঢাকা ও বরিশাল বিভাগে নিবন্ধন শুরু হয়েছে গতকাল রবিবার। প্রথম দিন দুটি বিভাগে নিবন্ধন করেছেন ৫৩ হাজার ৪৫৬ জন। প্রথম পর্যায়ে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে এই অনলাইন নিবন্ধন।
কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তিগত সমস্যা, বাড়তি অর্থ আদায় ও ভিড়ের কারণে প্রথম দিনই ভোগান্তির শিকার হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।
নিবন্ধনকাজ শুরু হয় গতকাল সকাল ৯টায়। চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। কয়েকটি জেলায় নিবন্ধনের কাজ বেশ ভালোভাবেই চলেছে। তবে এ দুটি বিভাগের বেশির ভাগ অংশেই ভোগান্তির শিকার হয়েছেন হাজার হাজার বিদেশগমনেচ্ছু। অভিযোগ উঠেছে উৎকোচ গ্রহণের। নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিবন্ধনের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
অভিযোগ উঠেছে, শত ভোগান্তি শেষে নিবন্ধন করা সম্ভব হলেও অনেক জায়গায় তথ্যকেন্দ্রের পরিচালককে (অপারেটর) বাড়তি টাকা দিতে হয়েছে। কোনো কোনো ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রে নিবন্ধনের জন্য সকালে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেও নিয়ম অনুযায়ী তাঁদের নিবন্ধন করা হয়নি। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের ঘনিষ্ঠ লোকজনই আগে নিবন্ধন করার সুযোগ পেয়েছেন। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের আশঙ্কা, প্রভাবশালীদের অবৈধ হস্তক্ষেপে সরকারের এমন ভালো উদ্যোগটি না শেষ পর্যন্ত বিফলে যায়।
দুটি বিভাগের একাধিক ইউনিয়ন তথ্যসেবাকেন্দ্রে গতকাল রবিবার সরেজমিনে পরিদর্শনকালে এমন চিত্রই দেখা গেছে। অবশ্য কোথাও কোথাও সুষ্ঠুভাবে নিবন্ধনের কাজ হয়েছে। নিবন্ধনকারীরাও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
এদিকে গতকাল রবিবার দুপুরে শ্রম ও প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন মানিকগঞ্জের শিবালয় মডেল ইউনিয়নের তথ্যসেবাকেন্দ্র পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের জানান, প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে নিবন্ধনে বিলম্ব হলে উদ্যোক্তারা রাতেও কাজ করবেন। এ ছাড়া নির্ধারিত নিবন্ধন ফির অতিক্তি টাকা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে নিবন্ধনের সময় বাড়ানো হবে না।
ঢাকা ও বরিশালের স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন বিস্তারিত।
মানিকগঞ্জ : প্রথম দিন বেশির ভাগ তথ্যসেবাকেন্দ্রেই কম্পিউটার সার্ভার ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্কসহ নানা সমস্যায় নিবন্ধন ফরম পূরণ করতে পারেননি উদ্যোক্তারা। এ কারণে নিবন্ধন না করেই ফিরে গেছেন অনেকে। সাটুরিয়া ইউনিয়নে তথ্যসেবাকেন্দ্র চালুই করা যায়নি। ঘিওর উপজেলার বড়টিয়া ও নালী এবং সদর উপজেলার ভাড়ারিয়া ইউনিয়নকেন্দ্রসহ অনেক স্থানে নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত ১০০ থেকে ২০০ টাকা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গফরগাঁও : উপজেলার ১৫টি তথ্যসেবাকেন্দ্রে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা করে আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। তা ছাড়া সার্ভার না পাওয়া, ইন্টারনেটের ধীরগতি ও সংযোগ না পাওয়া, সংযোগ পেলেও বারবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে নিবন্ধনের কাজ চরম ব্যাহত হয়েছে। সব মিলিয়ে দেখা দিয়েছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা।
বরগুনা : ৪২টি ইউনিয়নের তথ্যসেবাকেন্দ্রে নিবন্ধন কার্যক্রম চলেছে। তবে পাথরঘাটার কালমেঘা কেন্দ্রে নিবন্ধনে অতিরিক্ত ৫০ থেকে ১৫০ টাকা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
রূপগঞ্জ : দুপুর ১টার দিকে গোলাকান্দাইল ই-তথ্যকেন্দ্রে রজ্জব আলী মিয়া বলেন, 'সিরিয়াল না পাইয়া ফিরা যাইতাছিগা।' একই তথ্যকেন্দ্রে গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের হোড়গাঁও এলাকার সুরুজ মিয়া বলেন, 'এহানেও জালিয়াতি হইছে। হুনছি ৫০ টেকা কইরা লাগব। আমার কাছ থাইক্যা ৮০ টেকা নিছে।' বেলা আড়াইটায় মুড়াপাড়া ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায় শতাধিক লোকের জটলা। তারাবো পৌরসভার দীঘিবরাবো এলাকা থেকে নিবন্ধন করাতে এসেছেন আক্তার হোসেন। ১০ টাকা দিয়ে ফরম কিনেছেন। এরপর ৫০ টাকা দিতে হয়েছে ফরম পূরণ করতে। আরো ৫০ টাকা দিতে হয় ই-মেইল পাঠানোর জন্য। একই অবস্থা ছিল দাউদপুর, রূপগঞ্জ ও কায়েতপাড়া ইউনিয়নেও।
ঈশ্বরগঞ্জ (ময়মনসিংহ) : ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ ও নান্দাইল উপজেলার বেশির ভাগ ইউনিয়ন পরিষদে নিবন্ধন কার্যক্রমে গতকাল রবিবার প্রথম দিনেই ছিল হ-য-ব-র-ল অবস্থা। নান্দাইলের ১২টি ইউনিয়ন পরিষদের বেশির ভাগ তথ্যকেন্দ্রে নিবন্ধন করতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন মানুষ। গাংগাইল ইউপির সচিব জানান, তাঁদের তথ্যসেবাকেন্দ্রটি গাংগাইল বাজারে শাহীন মিয়ার দোকানে। বিদ্যুৎ না থাকায় ইউপি ভবনে তথ্যসেবার কাজ হয়নি। শাহীন মিয়া জানান, 'ইন্টারনেটের গতি খুবই কম। নিবন্ধনের কাজ চালানো যাচ্ছে না।'
নান্দাইল কেন্দ্রের কাজ হচ্ছে আসাদুজ্জামানের হেমগঞ্জ বাজারে। সেখানে বেলা দেড়টা পর্যন্ত সার্ভারের সংযোগ ছিল না। ভাটি সাভার গ্রামের আবু ফজল জানান, নাম নিবন্ধন করাতে ভোর থেকে এই দোকানের সামনে অপেক্ষা করলেও দুপুরে গিয়ে শেষ করতে পেরেছেন। বেতাগৈর কেন্দ্রের উদ্যোক্তা জানান, ইন্টারনেটে গতি কমে যাওয়ায় কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
মোয়াজ্জেমপুর তথ্যকেন্দ্রে বেলা পৌনে ২টা পর্যন্ত সার্ভার সংযোগ ছিল না। মুশুলি কেন্দ্রের নাম ও ইন্টারনেট মডেম নম্বর নিবন্ধন না হওয়ায় এই কেন্দ্রকে কোনো পিনকোড দেওয়া হয়নি। ফলে দিনভর ইউনিয়ন কার্যালয়ে শতাধিক মানুষ নিবন্ধনের জন্য ভিড় করলেও তাঁদের নিবন্ধন ছাড়াই ফিরে যেতে হয়েছে।
পিরোজপুর : গতকাল রবিবার সকাল থেকে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ১১ ইউনিয়নের ১১টি তথ্যসেবাকেন্দ্রে ছিল উপচেপড়া ভিড়। কিন্তু ইন্টারনেট দুর্বলতার কারণে অনলাইনে আবেদন পাঠাতে ব্যাপক বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় মানুষকে। ইন্টারনেট সংযোগই পাওয়া যায়নি। ফলে সেবা নিতে আসা মানুষজন চরম দুর্ভোগে পড়েন। দিনভর অপেক্ষা করেও অনেকে প্রথম দিন আবেদন পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান হাবিব কালের কণ্ঠকে বলেন, সব সীমাবদ্ধতা নিরসন করে তথ্যকেন্দ্রগুলো কার্যকরভাবে চালু করা হয়েছিল। নেটওয়ার্ক দুর্বলতায় সমস্যা হচ্ছে।
বরিশাল : নানা বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে গতকাল রবিবার বরিশালের ১০ উপজেলার তথ্যকেন্দ্রগুলোতে নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সকালে নিবন্ধন কার্যক্রমের শুরুতেই হোঁচট খেতে হয়েছে বেশির ভাগ তথ্যকেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের। বিশেষ করে সার্ভার বিচ্ছিন্ন, ইন্টারনেট সংযোগের গতি কম, নতুন পাসওয়ার্ড করা, প্রিন্টার ও স্ক্যানার মেশিন কাজ না করা, ঘন ঘন বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে ভোগান্তির শিকার হন বিদেশগমনেচ্ছুরা। ফলে দুপুর ১টার আগে বেশির ভাগ কেন্দ্রে কাজ শুরু হয়নি।
জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম সূত্র জানায়, জেলার ৮৫টি তথ্যকেন্দ্রের মধ্যে ৭৮টি চালু আছে। আটটি কেন্দ্র বন্ধ, আটটি কেন্দ্রের আবেদনকারীদের নিবন্ধন পাশের ইউনিয়নের কেন্দ্রে হচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকা ১৯টিতে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে।
মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বলেন, উপজেলার ১৩টি তথ্যকেন্দ্রের মধ্যে সাতটি বন্ধ। ওইসব তথ্যকেন্দ্রের ইন্টানেট সংযোগের নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না।
নারায়ণগঞ্জ : পাঁচ উপজেলার ২৮ ইউনিয়নের তথ্যকেন্দ্রে গতকাল রবিবার সকাল থেকে রেজিস্ট্রেশন শুরু হয়। তবে সদর উপজেলার বক্তাবলী, আলীরটেক, গোগনগর ও এনায়েতনগরসহ ৯ ইউপিতে রেজিস্ট্রেশন তালিকা থেকে কারণ ছাড়াই বাদ পড়া, সার্ভারে সমস্যা, ইন্টারনেটে ধীরগতিসহ নানা কারণে রেজিস্ট্রেশন কাজ চলেনি। অনেকে পাশের ইউনিয়নে গিয়ে নিবন্ধন করেছেন।
কেরানীগঞ্জ : ১২টি ইউনিয়নে তথ্যসেবাকেন্দ্রগুলোতে নিবন্ধন করতে ভিড় জমে ভোর থেকেই। কিন্তু নিবন্ধন করতে না পেরে অনেকেই ফেরত যান। বেলা দেড়টায় শুভাঢ্যা ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলা বন ও পরিবেশ কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন, সার্ভেয়ার বশির উদ্দিন ও ভূমি অফিস সহকারী আনোয়ারের উপস্থিতিতে সেবা প্রত্যাশীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত ফি। এ সময় পরিদর্শনে আসা উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাশেদুল ইসলামের কাছে ভুক্তভোগীরা অনিয়মের কথা তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, দুই টাকার ফরম বিক্রি করা হচ্ছে ২০ টাকা। ফরম পূরণ করার জন্য নেওয়া হচ্ছে ৫০ টাকা এবং ইন্টারনেটে রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ নেওয়া হচ্ছে আরো ১০০ টাকা।

No comments

Powered by Blogger.