সঞ্চয়পত্র নিয়ে যত ভাবনা by রাশেদ রাবি্ব

বেশ কিছু দিন ধরে সঞ্চয়পত্র নিয়ে নানা ধরনের আলাপ আলোচনা চলছে। বিশেষ করে গত ১৩ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ে সঞ্চয়পত্রের সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল।
মন্ত্রণালয়ের আলোচনা শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত জানান, মূল্যস্ফীতি এবং সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কাছাকাছি থাকা উচিত। তিনি বলেন, বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ৫ শতাংশ এবং সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ৮ শতাংশ বা তার উপরে। অর্থমন্ত্রী এ বক্তব্যে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হবে কিনা এ বিষয়ে কোন মতামত প্রদান করেননি। তবে মূল্যস্ফীতির হার নিচে নামলে সুদের হারও নিম্নমুখী হতে পারে বলে তিনি জানান। মূলত তাঁর এই বক্তব্যের পর থেকেই চলছে নানা আলোচনা-পর্যালোচনা-গবেষণা।
স্বাধীনতার পর থেকেই অর্থনীতি পুনর্গঠনে সঞ্চয়পত্র একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ উত্তোলনের জন্য বাজারে বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র ছেড়ে থাকে। সঞ্চয়পত্র সরকারের কোন লাভজনক ব্যবসা নয়। বিভিন্ন সময়ের আর্থিক সঙ্কট নিরসনের জন্যই এটি গ্রহণ করা হয়ে থাকে। যেহেতু একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সরকার টাকা গ্রহণ করে তাই আমানতের বিপরীতে সুদ প্রদান করে থাকে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল। সঞ্চয়ের বিপরীতে অধিক মুনাফার জন্য রয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন কর্মসূচী। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আমানতের টাকা বিভিন্ন পুঁজি হিসেবে বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করে। এেেত্র প্রত্যেক বিনিয়োগকারীর ঝুঁকি থাকে। সে কারণে মুনাফার হারও বেশি থাকে। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের অর্থ সরকার পারতপ েকোন প্রকার বাণিজ্যিক কার্যক্রমে ব্যবহার করে না। যেহেতু সরকার আমানত হিসেবে টাকা গ্রহণ করে তাই আমানতকারীর আমানত থাকে সর্বোচ্চ নিরাপদ। দেশে দীর্ঘ সময় বিনিয়োগে মন্দা, জনসাধারণের মধ্যে ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতা কম, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সঞ্চয়ী প্রকল্পে সুদের হার কমানো ইত্যাদি কারণে আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই সরকারী সঞ্চয়পত্রের প্রতি অতিমাত্রায় আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং বিনিয়োগ করতে থাকে। দেখা যায়, যখন সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বেশি থাকে তখন এ খাতে সাধারণের সঞ্চয়ী প্রবণতা বেশি থাকে। যখন সুদের হার কমানো হয় তখন আমানতকারীদের সঞ্চয় অপোকৃত কমতে থাকে। কিন্তু চূড়ানত্ম নিরাপত্তাজনিত কারণে সঞ্চয়পত্রের আমানত কখনই নেতিবাচক পর্যায়ে যায় না। সঞ্চয় পরিদফতর সূত্রে জানা যায়, ২০০৫-০৬ সালে সঞ্চয়পত্রে মোট স্থিতি ছিল ৩ হাজার কোটি টাকা। ২০০৬-০৭ এ স্থিতি ছিল ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুদ সঙ্কোচন নীতিমালার কারণে স্থিতি নেমে আসে ২৫১৮ কোটি টাকায়। ল্য করলে দেখা যায়, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের স্থিতি পতনের মূল কারণ সুদের হার কমানো নয় বরং অপ্রদর্শিত অর্থ অপসারণ।
আমানত সংগ্রহের জন্য দেশে বেশ কিছু সঞ্চয় প্রকল্প চালু আছে। যেমন জাতীয় সঞ্চয়পত্র। এখানে গড় সুদের হার শতকরা ১১ শতাংশ। এর অধীনে তিন ধরনের সঞ্চয় প্রকল্প রয়েছে। ১) পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র। ১৯৭৭ সালে এই সঞ্চয়পত্র সরকারীভাবে চালু করা হয়। মেয়াদানত্মে ১২ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়। ২) তিন মাস অনত্মর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র। এটি একটি জনপ্রিয় সঞ্চয়পত্র। ১৯৯৮ সালে এই প্রকল্প চালু করা হয়। শতকরা ৮ শতাংশ হারে মুনাফা প্রদান করা হয়। বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ সামান্য গচ্ছিত অর্থ এই প্রকল্পে সঞ্চয় করে মাসিক মুনাফা গ্রহণ করে। ৩) পেনশন সঞ্চয়পত্র। কেবলমাত্র সরকারী অবসরভোগী কর্মচারীরাই পাঁচ বছর মেয়াদী এই সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে পারে। ২০০৪ সালে এই প্রকল্প চালু করা হয়। মেয়াদানত্মে ১২ শতাংশ মুনাফা প্রদান করা হয়। এছাড়া আরও একটি জনপ্রিয় সঞ্চয়পত্র রয়েছে ডাকঘর সঞ্চয়পত্র নামে। যেহেতু ডাকঘর দেশব্যাপী ব্যাংকের তুলনায় বেশি বিসত্মৃত, তাই পলস্নী এলাকা থেকে আমানত সংগ্রহের জন্য এই সঞ্চয় প্রকল্প চালু করা হয়। মেয়াদী ও সাধারণ দুই রকম ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের ব্যবস্থা রয়েছে। মেয়াদী হিসেবে মেয়াদানত্মে ১২ শতাংশ এবং সাধারণ হিসেবে ৭ শতাংশ হারে মুনাফা প্রদান করা হয়।
বাজারে সঞ্চয়পত্রের পাশাপাশি ট্রেজারি বন্ড ও তিন ধরনের বিল রয়েছে। বন্ড ও বিলগুলোতে ৮ থেকে ৯ শতাংশ সুদের হার থাকলেও সাধারণ মানুষ এর প্রতি তেমন আগ্রহী নয়। বেশিরভাগ েেত্রই বিভিন্ন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ট্রেজারি বন্ড ও বিল ক্রয় করে থাকে।
সঞ্চয়পত্রের জনপ্রিয়তা ও নিরাপত্তার কারণে প্রায় সকল শ্রেণী-পেশার মানুষই এখানে বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী। নিম্নআয়ের সরকারী চাকরিজীবী, ুদ্র ব্যবসায়ীরা যেমন জীবনের সর্বশেষ সঞ্চিত অর্থ দিয়ে বাকি জীবনের নিরাপত্তার জন্য সঞ্চয়পত্র ক্রয় করে, তেমনি উচ্চ-মধ্যবিত্ত থেকে শুরম্ন করে ধনিক শ্রেণীর বেশিরভাগ মানুষ তাদের অলস, অব্যহৃত, উদ্বৃত্ত অর্থ নিরাপদ হেফাজতে রাখার জন্য কৌশল হিসেবে সঞ্চয়পত্র কিনে রাখেন। হিসেব করলে দেখা যাবে স্বল্প আয়ের মানুষের তুলনায় ধনী লোকদের বিনিয়োগ অনেক বেশি। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্রের ওপর যাদের জীবন-জীবিকা অনেকাংশে নির্ভরশীল তাদের তুলনায় ধনিক শ্রেণীর বিনিয়োগ বেশি হওয়ায় এ বিষয়ে সংশিস্নষ্টদের চিনত্মাও অনেকটা কম। অর্থাৎ যেখানে দরিদ্রের জীবনধারণ চিনত্মা, সেখানে ধনীদের প্রশ্ন নিরাপত্তার।
সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল এমন কিছু লোক মনে করেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সুদের হার কমানোর ফলে মানুষ সঞ্চয়পত্রমুখী হয়েছে। যার ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আমানতে কিছুটা শৈথিল্য বিরাজ করছে। এখন যদি সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানো হয় তাহলে অনেকে হয়তো আবার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে। তবে ব্যাংক কর্মকর্তারা এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন না। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বলা যায়, যাঁরা সঞ্চয়পত্র ক্রয় করেন তাঁদের একটি বৃহৎ অংশ অবসরপ্রাপ্ত, বিধবা, এবং নিম্নআয়ের মানুষ। তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা এই সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাদের কথা চিনত্মা করে এবং সরকারের আপৎকালীন কথা ভেবে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো অনুচিত। যেহেতু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সময় সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়ে না বা বাড়ানো হয়নি, তাই মূল্যস্ফীতিজনিত কারণে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার পুনর্নির্ধারণ সময়োপযোগী নয়।

No comments

Powered by Blogger.