চীন ও গুগল কুনত্মল রায়

চীন থেকে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার সিদ্ধানত্ম নিচ্ছে বিশ্বের দ্রম্নততম ও অন্যতম ইন্টারনেটভিত্তিক সার্চ ইঞ্জিন গুগল। 'চীন তথ্যের অবাধ প্রবাহের ৰেত্রে অন্যতম বাধা'_ গুগলের প্রধান নির্বাহী এরিক স্মিডের এই বক্তব্যই স্পষ্ট করে দিয়েছে চীন সরকারের সেন্সরশিপের বেড়াজালে আটকে পড়ে হতাশ গুগল।
এরিক স্মিড বলে দিয়েছেন, সেন্সরশিপ না ওঠালে চীন থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেবে গুগল। তবে শুধুমাত্র গুগলই নয়, সাম্প্রতিককালে চীন থেকে বিভিন্ন বিদেশী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে। গুগলের পরিণতি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এর নেপথ্যে রয়েছে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও পরিবর্তিত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্কের যে আকস্মিক পরিবর্তন এসেছে। তা খুব স্পষ্টই বোঝা যায়। আশি নব্বইয়ের দশকে চীন বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য উদার বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করে। বিশেষত মার্কিনীদের প্রতি তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব গড়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র ঁপৃথিবীর অন্যতম শিল্পোন্নত দেশ হওয়ায় তাদের প্রচুর পরিমাণ উদ্বৃত্ত পুঁজির ওপর চীনের নজর ছিল। চীনের উদারনীতি এবং বিদেশী বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত দ্বার মার্কিনীদের চীনে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করে। মার্কিন প্রযুক্তি পুঁজি বিনিয়োগের সঙ্গে চীনে প্রবেশ করে এবং মার্কিন-চীন সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। অর্থনৈতিক স্বার্থের পাশাপাশি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও হাসিল হয় চীনের। যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরে তারা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় প্রবেশ করে। এ জন্যই দেন জিয়াওপিং থেকে জিয়াং জেমিন সরকারের মার্কিন আনুগত্যে কোন ঘাটতি দেখা যায় না। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে চীন বদলাচ্ছে। চীনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আর প্রয়োজন হচ্ছে না। কোপেনহেগেনে জলবায়ু সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা পশ্চিমা দুনিয়ার প্রতি চীনের মনোভাব এটাই প্রমাণ করে।
সম্মেলনে মার্কিন-চীন প্রতিনিধিদলের সভায় প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে এক চীনা প্রতিনিধির অশোভন আচরণ স্পষ্টতই প্রমাণ করে, চীনের আর যুক্তরাষ্ট্রকে বন্ধু হিসেবে প্রয়োজন নেই। বিগত কয়েক বছরে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নিজস্ব উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অভ্যনত্মরীণ বাজারের প্রসার চীনের সামগ্রিক পরিবর্তনের মূলে। চীনের নিজস্ব পুঁজি এখন উদ্বৃত্ত রূপ ধারণ করেছে। তারা আর পশ্চিমা পুঁজির মুখাপেৰী নয়। এ জন্যই পশ্চিমা আদর্শ এবং সরকারের সঙ্গে চীনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এমআইটির গবেষক ইয়াশেং হুয়াং তার সাম্প্রতিক গবেষণায় চীনের বর্তমান বৈদেশিক নীতির আরেকটি কারণ উলেস্নখ করেছেন। হুয়াং-এর মতে, আশি বা নব্বইয়ের দশকে চীনের উৎপাদন ছিল প্রধানত গ্রামীণ ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের। বর্তমানে উৎপাদন নগরমুখী। পাবলিক সেক্টরে প্রচুর বিনিয়োগ চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে দ্রম্নত বাড়িয়ে তুলেছে। যার উদাহরণ গত বছর চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১২.৩ শতাংশ। স্পষ্টতই বিশ্বের প্রতি চীনের পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির একটি ছোটখাটো উদাহরণ হলো গুগল ও চীনের দ্বন্দ্বযুদ্ধ। গুগলের প্রধান নির্বাহী চীনের তথ্যপ্রবাহে বাধা এবং যোগাযোগ প্রক্রিয়ায় অসহযোগিতার কড়া সমালোচনা করে বলেছেন, এর ফলে চীনের আকাঙ্ৰিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সৃজনশীলতা কখনোই সৃষ্টি হবে না। তবে স্মিড সমালোচনা করম্নন আর যাই করম্নন, এ কথা স্পষ্ট যে ইন্টারনেট চীনকে বদলাতে পারেনি, বরং চীনই ইন্টারনেটকে বদলে দিয়েছে। ব্যাপক শিল্প উৎপাদন এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন চীনের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তুললেও বিশ্বের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কি গ্রহণযোগ্য ? এ নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ চীন যদি প্রকৃতই বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হতে চায়, তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক এবং চলমান আধুনিকীকরণের সঙ্গে একাত্ম হওয়া প্রয়োজন। গুগলের সিদ্ধানত্মের বিপরীতে বেজিং কি পদৰেপ নেয়, তার ওপর অনেকাংশেই নির্ভর করছে চীনের বিশ্বনেতৃত্বে যোগদান করার ৰমতা।

No comments

Powered by Blogger.