কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তাদের মানবাধিকার- রেভাঃ মার্টিন অধিকারী

আজ ৩১ জানুয়ারি, বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস। কুষ্ঠরোগের বিষয়ে ভুল ধারণার কারণে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যুগ যুগ ধরে সমাজ, এমনকি একান্ত আপনজনদের কাছেও অবহেলিত ও লাঞ্ছিত। অতীতে এ অবস্থা ছিল অত্যন্ত করুণ ও অমানুষিক।
সভ্যতার আলোয় আমাদের সেই অন্ধকার আজ অনেক দূর হয়ে গেলেও আজও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ও সমাজে কুষ্ঠাক্রান্ত মানুষের প্রতি ঘৃণা ও অস্পৃশ্যতার দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা রয়ে গেছে। আমাদের দেশে তাই কারও কুষ্ঠ হলে তাকে অনেক দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার আঘাত সহ্য করে জীবনকে বড় এক বোঝার মতো মেনে নিয়ে চলতে হয়। এসব মানুষের জীবনকে সমাজ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বিধ্বস্ত করে দেয়। অন্ধ তারা নয়, প্রতিবন্ধী তারা নয়; কিন্তু তথাকথিত সভ্য সমাজ তাদের তির্যক দৃষ্টিতে দেখে।
কুষ্ঠরোগের শিকার মানুষের জন্য কাজ করেন এমন কিছু বেসরকারী সংগঠনের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটি প্রতিষ্ঠান হলো লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল। ১৮৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লাখ লাখ কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত মানুষের জীবনে আশার আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। যীশু খ্রিস্টের মানব-প্রেম ও সেবার মহান আদর্শকে অনুসরণ করে আমাদের দেশেও সে সেবার কাজ করে চলেছে গত শতাব্দী থেকে। দেশে বর্তমানে ২১টি প্রকল্পের মধ্য দিয়ে ২৪টি জেলায় লেপ্রসি মিশন কুষ্ঠ সম্পর্কে সঠিক শিা ও তথ্য প্রদান, গণসচেতনতা সৃষ্টি করা, কুষ্ঠরোগীদের শনাক্ত করা, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান, রোগের শিকার ব্যক্তিদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাসহ তাদের আর্থ-সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করা ইত্যাদি সামগ্রিক সেবার কাজ করছে। লেপ্রসি মিশনের বিভিন্ন প্রকল্প এলাকার মধ্যে যে সমস্ত হতভাগ্য মানুষের জীবন অস্পৃশ্যতার চরম শিকার হয়েছে তাদেরই কয়েকজনের করুণ অবস্থার কাহিনীর মাত্র দুটি নিচে উল্লেখ করছি। এগুলোর সবই বাস্তব চিত্র।
জাহাঙ্গীর আলমের বয়স ৫২ বছর। তিনি থাকেন ঢাকা শহরে। বর্তমানে লেপ্রসি বা কুষ্ঠরোগের কারণে প্রতিবন্ধী। তাঁর দুই পায়ের আঙ্গুল নেই এবং চোখেও ঠিকমতো দেখতে পান না। জাহাঙ্গীর লেখাপড়া করেননি; সুস্থ অবস্থায় তিনি রিক্সা চালাতেন। বর্তমানে কিছুই করতে পারেন না। তাঁর স্ত্রী এবং এক মেয়েও লেপ্রসিতে আক্রান্ত। তাঁর পাঁচটি মেয়ে। দুই মেয়ে গার্মেন্টসে কাজ করে এবং এক মেয়ে ভাঙ্গারি টোকায়। দুই মেয়ের উপার্জনেই তাদের সাতজনের সংসার চালাতে হয়। একটা ছোট্ট কামরার মধ্যে তাঁরা সবাই মিলে থাকেন। নিজস্ব কোন জায়গা নেই। কুষ্ঠরোগ থাকার কারণে মানুষ তাদের সঙ্গে মিশতে চায় না। তাদের ঘর থেকে পানি বা অন্য কোন কিছু কেউ খেতে চায় না। কুষ্ঠরোগের কারণে তাদের প্রতিবেশী এবং আত্মীয়স্বজনরা তাদের ঘৃণাও করে। তাদের বাসায় আত্মীয়স্বজনরা আসতে চায় না। তারা যখন তাদের কাপড়চোপড় ধুয়ে বাইরে শুকাতে দেয় তখন প্রতিবেশীরা তাদের কাপড়চোপড়ের পাশে তা শুকাতে চায় না। তার ছেলেমেয়েরা খেলতে গেলে প্রতিবেশীরা তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলতে দিতে চায় না। ওরা যদি অন্যের বাসায় যায় তাহলে তারা তাদের ঘর ধুয়ে ফেলে এবং তাদের গালাগালি করে। বলে যে তাদেরকে পাপে ধরেছে, তাই তাদের এই কুষ্ঠরোগ হয়েছে। সমাজে থেকেও তারা অন্য মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন। লেপ্রসি মিশন থেকে তারা বয়স্ক শিা পেয়েছে। তাদেরকে সচেতনতামূলক প্রশিণ 'সেলফ কেয়ারম্ব প্রশিণও দেয়া হয়েছে।
মাসতুমার। মাসতুমার চার বোন ও এক ভাই। এদের মধ্যে তিন বোন এবং ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে। মাসতুমারা থাকেন রংপুরে। তাঁদের কেবল বসতভিটা আছে, চাষের কোন জমি নেই। মাসতুমার ভাই রিক্সা চালান, মা বিড়ির ঠোস বানান। পরিবারে অন্য কারও কুষ্ঠ নেই। কুষ্ঠ রোগের কারণে মাসতুমার হাত-পায়ের আঙ্গুল যথেষ্ট তিগ্রস্ত হয়েছে। কুষ্ঠরোগের কারণেই তাঁর বিয়ে হয়নি। যেহেতু তাঁর হাত এবং পা অকার্যকর এবং কোন কাজই করতে পারেন না, তাই তাঁর মা এবং ভাই দুর্ব্যবহার করে তাঁকে ঘর থেকে বের করে দেন। ফলে মাসতুমা অন্য একটা ঘরে একা বসবাস করতে শুরু করেন। প্রতিবেশী মহসিন ওরফে গাট্টু মিঞা (৫০) মাসতুমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাকে প্রলোভন এবং ভয় দেখিয়ে তার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। লোকটি বিবাহিত এবং চার সন্তানের পিতা; মেয়েদের বিয়েও দিয়েছেন। মাসতুমা গর্ভবতী হয়ে পড়লে গাট্টু মিঞা সবার অজান্তে তাকে নানা রকম ওষুধ খাওয়ান গর্ভপাত করানোর জন্য। কিন্তু যখন তাতে কাজ হয়নি তখন দেড় শম্ব টাকা মাসতুমার হাতে দিয়ে হাসপাতালে পাঠান। ডাক্তার গর্ভপাত করাতে রাজি না হওয়াতে মাসতুমা লেপ্রসি মিশনের নারী নিকেতনে আশ্রয় নেন। পরে মাসতুমার একটি মেয়ে হয়। গাট্টু মিঞা বাচ্চার দায়দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। সমাজের ভয়ে মাসতুমা বাচ্চাটিকে নিঃসন্তান দম্পতির কাছে দত্তক দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাচ্চাটির প্রতি তার মায়া জন্মানোর কারণে শেষ পর্যন্ত নিজের কাছেই রেখে দেন। বিষয়টা জানাজানি হতে থাকে। গ্রামের লোকেরা মাসতুমার ওপর প্তি হয় এবং তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে মাসতুমাকে গ্রামে ঢুকতে দেবে না। এদিকে গাট্টু মিঞা মাসতুমাকে বারো হাজার টাকা দিয়ে মেয়ের দায়দায়িত্ব নেয়া থেকে মুক্ত হতে চান। মাসতুমা রাজি না হওয়াতে গাট্টু মিঞা বাড়িঘর ফেলে বড় বৌকে নিয়ে অন্য জায়গায় চলে যান। লেপ্রসি মিশনের কমর্ীরা মাসতুমার পরিবার এবং গ্রামের লোকদের সঙ্গে কাউন্সেলিং করে এবং গ্রামে সালিশ বৈঠক ডেকে মীমাংসার মধ্য দিয়ে মাসতুমার এবং তার মেয়ের অধিকার আদায়ের চেষ্টা করেন। প্রথমে গাট্টু মিঞা সালিশ করতে না চাইলেও লেপ্রসি মিশনের কমর্ীরা তাকে কৌশলে রাজি করিয়ে সালিশে নিয়ে আসেন। পরবর্তীকালে সালিশের সিদ্ধান্তে পঞ্চান্ন হাজার টাকা দেনমোহরে গাট্টু মিঞার সঙ্গে মাসতুমার বিয়ে হয় এবং গাট্টু মিঞাকে বাচ্চার ভরণপোষণের জন্য মাসে দেড় হাজার টাকা এবং এক শতাংশ জমি লিখে দিতে বলা হয়। বিয়ে করার পর মাসতুমাকে ফেলে রেখে গাট্টু মিঞা আবার পালিয়ে যায়। মাসতুমা লেপ্রসি মিশন থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে এক বান টিন, দুটা গাভী পেয়েছেন। এছাড়া মিষ্টির কার্টন বানানোর প্রশিণও দেয়া হয়েছে তাকে।
আমাদের সরকার ও আমরা দিন বদলের আশায় চলছি। আমাদের একান্ত প্রত্যাশা_ এদেশের লাখ লাখ দুঃখী মানুষের মাঝে কুষ্ঠাক্রান্ত অনেক মানুষের জীবনও যেন দিন বদলের ছোঁয়া লাভ করে। এ মর্মে সরকারী-বেসরকারী সকল কর্মোদ্যমের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সমাজের সকল মানুষের কুষ্ঠরোগ ও তার দ্বারা আক্রান্ত মানুষের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের মূল কথা : কুষ্ঠরোগ কোন অভিশাপ নয়; এ রোগের বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়া যায়; রোগ ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করা জরুরী; নতুবা আক্রান্ত ব্যক্তি প্রতিবন্ধিতার শিকার হতে পারেন। এ রোগের কারণে যে কোন প্রকারের সামাজিক বৈষম্য বড় অপরাধ।

লেখক : পরিচালক, এ্যাডভোকেসি এ্যান্ড প্রোমোশন, লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ

No comments

Powered by Blogger.