একুশ শতক- ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন এবং তার ভিডিও রূপানত্মর_ দুই by মোসত্মাফা জব্বার

দেশের সর্বত্র সকল পর্যায়ে ব্যাপকভাবে আলোচিত ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নটাকে আমার কখনই এত অসম্ভব স্বপ্ন মনে হয় না। কারণ আমরা এখন একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন জাতি এবং নানা প্রতিকূলতার মাঝেও আমরা আটত্রিশ বছর ধরে সামনেই পা ফেলেছি।
পৃথিবীর কোন শক্তি এই কোটি জনতাকে খুব বেশি সময় বিভ্রানত্ম করতে পারবে না। বেশি দূর বিভ্রানত্ম করে নিয়ে যেতে পারবে না। অনেক ব্যর্থতা, অনেক পশ্চাৎপদতার মাঝেও আমাদের অনেক সাফল্য রয়েছে। ব্যক্তিগত সাফল্য আছে। পরিবারে, রাষ্ট্রে সাফল্য আছে। সবচেয়ে বড় সফলতা এই যে, আমরা সাড়ে সাত কোটি থেকে সাড়ে ষোল কোটি মানুষ হয়েও এখন পর্যনত্ম খেয়ে বেঁচে আছি। খাবারের অভাবে বেশ ক'টি দুর্ভিৰ এখনও হয়নি। অন্যদিকে এখনও আমরা ব্যর্থ রাষ্ট্র বা জঙ্গীবাদী পাকিসত্মান রাষ্ট্র হইনি।
সেসব কারণেই আমার ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নটা এমন একটি স্বপ্ন, যাকে আমি মনে করি এই জাতি স্বাধীনতার আরও অনেক কম মূল্যে পেতে পারে।
যাহোক, যিনি যেভাবেই দেখুন না কেন, যে ভাষাতেই এর প্রকাশ ঘটুক না কেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের এক অপূর্ণ আকাঙ্ৰা বাসত্মবায়নের স্বপ্নের নাম। স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পার হবার পর এই জাতি তার অতীতের সকল সাফল্য-ব্যর্থতাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ নামে একটি রূপকল্প তৈরি করেছে। এই রূপকল্প তাকে সন্ধান দিয়েছে তার স্বপ্নের দেশের আরব্ধ ঠিকানার। বলা যায়, একাত্তরে দেশ স্বাধীন করার পর ২০০৮ সালে এই জাতি আবার নতুন করে এক স্বপ্নের ঠিকানায় নৌকা ভাসিয়েছে। সেই স্বপ্নটা আমাদের সত্যিকারের সোনার বাংলার। একুশ শতকের ডিজিটাল বাংলাদেশের।
সেই স্বপ্নটা এমন সুন্দর : মাঝে মাঝে আমি দুই হাজার একুশ সালের ১৬ ডিসেম্বরে চলে যাই। ততদিন বেঁচে থাকব কিনা জানি না, তবে বেঁচে থাকতে চাই এবং সেজন্য স্বপ্নও দেখি। তখন; স্বাধীনতার সুবর্ণজয়নীিতে আমি দেখতে পাই, সমাজে জ্ঞানই শক্তির কেন্দ্র হয়েছে বলে অর্থ-বিত্তের চাইতে জ্ঞানের প্রভাব কেবল বেশি নয়, নিরঙ্কুশভাবে সর্বত্র বিরাজ করছে। এখন থেকে সেদিন পর্যনত্ম বিদ্যমান সমাজে, রাষ্ট্রে, সংস্কৃতিতে, জীবনাচারে বা জীবনধারায় একটি বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে। প্রচ- রূপানত্মরের মাঝে সামনে গেছে দেশ-সমাজ। সমাজে জ্ঞানী ও প-িত ব্যক্তিরা সর্বত্র সম্মানিত হচ্ছেন। শারীরিক শক্তিবান ও আর্থিকভাবে ধনবানদের চাইতে মেধার ধারসম্পন্ন জ্ঞানীদের মর্যাদা হয়েছে অনেক বেশি। এই সময়ের মাঝে জীবনের সকল ৰেত্রেই নতুন একদল জ্ঞানকর্মী তৈরি হয়ে গেছে। এই জ্ঞানকর্মীরা সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র নেতৃত্ব দিচ্ছে। পেশীশক্তি ও অর্থ-বিত্তের আধিপত্য বিলীন হয়ে গেছে। জ্ঞানীদের সংখ্যা বেশি হয়েছে বলে সাধারণভাবে বাংলাদেশের একুশ শতকের ইতিহাস তাঁরাই রচনা করছেন। অর্থনীতি ডিজিটাল ও জ্ঞানভিত্তিক হয়েছে বলে কৃষি ও শিল্পের চাইতে মেধাভিত্তিক সেবা ও শিল্প-কারখানার প্রসার বেশি হচ্ছে। কৃষিতে কাজ করছে শতকরা বড়জোর সাত ভাগ লোক। তবে তারাও প্রচলিত অর্থে কেউ অশিৰিত নেই। কৃষি তাদের পেশা হয়েছে বটে, কারণ সেই খাতে তারা অনেক বেশি উপযোগ যুক্ত করতে সৰম হচ্ছেন। তখন শতকরা ষাট ভাগের বেশি লোক কাজ করছে সেবাখাতে। এই সেবাখাতের পরিধি হয়েছে অনেক সুবিসত্মৃত। বাকিরা কাজ করছে ২০১০ সালের ধারণার শিল্প-কল কারখানায়। বস্তুগত সম্পদের চেয়ে মেধাজাত সম্পদ সৃষ্টির প্রতি সবার বেশি আগ্রহ রয়েছে। মেধার বিকাশ, সংরৰণ ও সৃজনশীলতাই হচ্ছে নীতি ও নৈতিকতার কেন্দ্র। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের জ্ঞানভিত্তিক সৃষ্টির বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে। প্রচলিত কৃষি-শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবকিছুতে বঙ্গবাসীর বিজ্ঞান চর্চা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কল্যাণে তথা মেধার স্পর্শে মূল্য সংযোজন এমনভাবে হচ্ছে যে, বস্তুগত মূল্যের চেয়ে মেধাজাত মূল্য সংযোজন অনেক বেশি হচ্ছে। নারী ও তরম্নণরা এইসব কাজে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকছেন। বয়স্করা প্রধানত অভিভাবকত্ব এবং অবসর জীবনে অভ্যসত্ম হয়ে পড়ছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের অর্থনীতি হয়ে ওঠেছে ব্যাপকভাবে চাঙ্গা। দুই ডিজিটের নিচে কোন বছরে প্রবৃদ্ধি হয় না। অর্থনেতিক কর্মকা-ে পুরো জাতির অংশগ্রহণ এমন একটি অবস্থায় বিরাজ করছে যে আমরা বিদেশী সহায়তা-বিশ্বব্যাংক, আইএমএফদের কথা ভুলে গেছি। ওরা বাংলাদেশে অফিস রাখার প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। নিজেদের অর্থ দিয়ে আমরা আমাদের উন্নয়ন করছি। দাতারা আমাদের জন্য প্রেসক্রিপশন দিতে পারছে না_বরং বলা যায় আমরা তাদের ধার ধারি না। বরং আমরা দুনিয়াকে দেখিয়ে দিচ্ছি জ্ঞানভিত্তিক সমাজের রূপরেখা কেমন হয়।
আমরা স্বপ্ন দেখি, এই সময়ের শেষে পুরো দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে কোন মানুষ বসবাস করবে না। দেশে নূ্যনতম সচ্ছল মানুষ সবাই হবে। সমাজে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক_এমন খুব বেশি ধনী কোন মানুষ বা পরিবার থাকবে না। লুটেরা বিকারগ্রসত্ম ধনবাদী শিল্পগোষ্ঠীর বিপরীতে রাষ্ট্রীয় সম্পদে জনগণের মালিকানা বা সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। বড় বড় শিল্প-কলকারখানা থাকবে। তবে এসব কারখানার শেয়ার হোল্ডাররা বা মালিক থাকবে সাধারণ জনগণ। দেশে ব্যাপকভাবে ছোট ও মাঝারি পুঁজির বিকাশ ঘটবে। এসব পুঁজি হবে ব্যক্তি বা পারিবারিক মালিকানার। তবে রাষ্ট্রীয় নীতিমালার জন্য ধনী আরও ধনী হওয়ার সুযোগ পাবে না। মাঝারি আয়ের মধ্যবিত্তের সংখ্যাই অধিক হবে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিৰা, নিরাপত্তা কোনটাই কোন মানুষের সঙ্কট হবে না। সবাই তার নূ্যনতম প্রয়োজন মেটাতে পারবে। অন্নের অভাবে পড়বে না কোন মানুষ। সারাদেশে থাকবে না কোন বস্ত্রহীন মানুষ। ছিন্নমূল বাসস্থানহীন কোন মানুষ পাওয়া যাবে না। রাসত্মায় ভিৰুক পাওয়া যাবে না। সরকারী খাস জমি, ফুটপাত, রেল স্টেশন, লঞ্চঘাট বা অন্য কোথাও ঝুপড়ি ঘরের বসত্মিতে কেউ বাস করবে না। নিজের হোক, ভাড়ায় হোক একটি নিরাপদ আবাস প্রতিটি মানুষের থাকবে। প্রতিটি মানুষের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সেবা পাওয়া যাবে। বিনা চিকিৎসায় মরবে না কেউ। প্রতিটি মানুষের জন্য ডাক্তার-হাসপাতাল-ওষুধ পাওয়া যাবে। গ্রামের হোক আর শহরের হোক নূ্যনতম চিকিৎসার ব্যবস্থা সবার জন্যই বিরাজ করবে। সরকার সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। বেনিয়া চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সে পেতে পারবে। ডিজিটাল যন্ত্র প্রতিটি মানুষের কাছে সেই সুযোগ পেঁৗছে দেবে। এমনকি দেশের বাইরের বিশেষজ্ঞদের কাছে একজন সাধারণ মানুষকে পেঁৗছানোর ব্যবস্থা করে দেবে রাষ্ট্র।
জাতীয় সংসদ হবে ডিজিটাল। এই সংসদের সংসদ সদস্যরা ডিজিটাল জীবনযাপনে অভ্যসত্ম হবেন এবং তাদের সব কাজ ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন হবে। তারা সবাই ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করবেন এবং সংসদের সব কর্মকা- ডিজিটাল উপায়ে প্রকাশিত হবে ও দেশবাসীর কাছে সহজলভ্য হবে। কোন সাংসদ নিজে উপস্থিত না থেকেও সংসদের কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন। জনগণও তার নিজের বাড়িতে বসে থেকেই সংসদের কাজকর্মে অংশ নিতে পারবেন। রাজনীতি নষ্টামিতে ভরা থাকবে না। দুর্বৃত্তায়ন পাওয়া যাবে না তাতে। রবে না লুটেরা রাজনৈতিক সংস্কৃতি। মানুষ রাজনীতিবিদদের চোর-মহাচোর বলবে না, সম্মানের চোখে দেখবে তাদের। রাজনীতিবিদদের দেশপ্রেমিক বলে মনে করা হবে। রাজনীতিকরা গম বিলি, টিন আত্মসাত, মামলাবাজি, দলবাজি, কমিশনবাজি এসব করবেন না। তাদের হ্যামার-জাগোয়ার-মার্সিডিজ বেঞ্জ থাকবে না, মগজের ধার থাকবে। সংসদ সদস্যরা উপজেলা পরিষদ বা টিআরের পেছনে লেগে থাকবেন না। তারা জাতীয় সংসদে বসে আইন প্রণয়নে নিমগ্ন থাকবেন। তারা দেশের জন্য একুশ শতকের আইন প্রণয়ন এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় মানুষের করণীয় বিষয়াদি নিয়ে গবেষণা করবেন ও জাতিকে দিকনির্দেশনা দেবেন। দেশে একটি সচেতন নাগরিক সমাজ দেশবাসীর সব ধরনের বিষয়াদিসহ মানবাধিকারের বিষয়গুলোও মনিটর করবে।

তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সরকার হবে ডিজিটাল। সেটি হবে দৰ ও জনগণের সেবক। সরকারের সব তথ্য নাগরিকরা যে কোন সময় যে কোন স্থান থেকে জানতে পারবে। বিচার হোক আর সরকারের কাছে কোন আবেদন হোক, কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন বা অন্য কোন ডিজিটাল যন্ত্রে ডিজিটাল উপায়ে নাগরিকরা সরকারের কাছে পেঁৗছাতে পারবে। কাউকে সশরীরে সরকারী অফিসে আসতে হবে না। সরকারের নাগরিক সেবা হবে এমন যেন সরকারী অফিস নামক কোন বস্তু অদৃশ্যে বসবাস করে। সরকারের সকল তথ্য থাকবে ডিজিটাল পদ্ধতিকে সংরৰিত করা। তারা নিজেরা এবং অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন ডিজিটাল উপায়ে। কাগজের ফাইল বা কাগজের চিঠি দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হবে এবং সেইসব দেখার জন্য মানুষ জাদুঘরে যাবে। সরকারী কর্মচারীরা বাড়িতে, অবকাশ কেন্দ্র বা বিদেশে থেকে অফিস করতে পারবেন এবং তাদের শারীরিক উপস্থিতি বাধ্যতামূলক হবে না। মানুষ ঢাকা শহরের সরকারের কাছে আসবে না, সরকার যাবে তার গ্রামের বাড়িতে, পর্ণকুটিরে। সে নিজে সিদ্ধানত্ম নেবে কোথায় তার উন্নয়ন হবে_সরকার তার সিদ্ধানত্ম অনুসারে কাজ করবে। উৎপাদন ব্যবস্থা যাবে বদলে। শ্রমঘন বিপজ্জনক শিল্প কারখানায় মানুষের কাজ হবে কেবল নিয়ন্ত্রণ করা। যন্ত্রপাতি করবে উৎপাদন। মানুষ করবে সেই উৎপাদন ব্যবস্থার মনিটরিং। কৃষি কাজ পর্যনত্ম চিপস নির্ভর হবে।
কাস্টমস অফিসাররা ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ করবেন। আমদানি ও রপ্তানিকারকরা বন্দরে না গিয়েই আমদানি-রপ্তানি করবেন-কর বা শুল্ক দেবেন ও মাল পাঠাবেন বা খালাস করবেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ইন্সপেক্টর, কমিশনার বা অন্য কারও চেহারা কোন নাগরিককে দেখতে হবে না। তারা ডিজিটাল উপায়ে কর রিপোর্ট ও কর দেবেন।
কৃষক তার বাড়িতে বসে জানতে পারবে তার জমিতে এখন কি পরিমাণ সার বা সেচ দিতে হবে। কৃষিঋণের জন্য তাকে আবেদন করার জন্য উপজেলায় বা ব্যাংকে যেতে হবে না। পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সে সহায়তা পাবে মোবাইল ফোনে। কৃষিপণ্যের বাজার দর সে জানতে পারবে তার হাতের ডিজিটাল যন্ত্রে। ঝড়-ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি-খরা, আগাম বা অকাল বন্যার খবর পাবে সে মাস খানেক আগে। অতি উন্নত জাতের বীজের জন্য তার ফসল যাবে বেড়ে। হাস, মুরগি, গবাদি পশু বা কৃষির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সব বিষয়ে সে তার নিজের ঘরেই তথ্য পাবে।

২৯ জানুয়ারি ২০১০ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, ঔপন্যাসিক, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান-সাংবাদিক, কম্পিউটার বিষয়ক বই-পত্র ও নিবন্ধের লেখক ও কলামিস্ট এবং বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এর জনক ই-মেইল ঃ সঁংঃধভধলধননধৎ@মসধরষ.পড়স, ওয়েবপেজ: িি.িনরলড়ুবশঁংযব.হবঃ

No comments

Powered by Blogger.