তাপমাত্রায় নতুন রেকর্ড এবং কিছু কথা by নিয়ামত হোসেন

শীতের রেকর্ড হয়েছে সৈয়দপুরে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ রেকর্ড। তিন ডিগ্রীতে নেমে গিয়েছিল তাপমাত্রা। এই রেকর্ড আর যেন না ভাঙ্গে সেই কামনা সবার মনে। সারাদেশে এবার যে শীত পড়েছে তা এক কথায় মারাত্মক।
শীত কাকে বলে এবারের শীত সেটা বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আমরাও বুঝছি তা হাড়ে হাড়ে। আবহাওয়া যে পাল্টাচ্ছে সেটা একেবারে পরিষ্কার হচ্ছে এবার। বলা হয় এদেশ গ্রীষ্মপ্রধান। কেউ কেউ বলেন, নাতিশীতোষ্ণ। এখন শীতের যে ধারা সেটা যদি পরের শীতগুলোতেও চলে তাহলে কি দেশটা শীতপ্রধান হতে বাকি থাকবে? নাকি আবার গ্রীষ্মে চরম দাবদাহে ছাতি ফেটে যাওয়ার মতো গরম পড়লে তখন কি বলতে হবে এটা গ্রীষ্মপ্রধান দেশ? তবে গরমে মারাত্মক গরম, শীতে ভয়াবহ শীত এবং বর্ষায় অবিরল ধারা ঝরতে থাকলে তখন বলতেই হবে জলবায়ু চরমভাবে বদলে গেছে। আমাদের আবহাওয়া হয়ে পড়েছে চরম ভাবাপন্ন।
অমন চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া হলে তখন কষ্টের আর শেষ থাকবে না। হারিয়ে যেতে থাকা যে ঋতুগুলোর জন্য এখন খানিকটা আফসোস হয়, তখন মিষ্টি মিষ্টি আবহাওয়ার অনেকগুলো ঋতু একেবারে হারিয়ে যাবে, সেটা হলে আমাদের আর সীমা থাকবে না।
তবে বিশ্বের জলবায়ু পাল্টাচ্ছে। আবহাওয়ার বদল ঘটছে। এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, সবাই বুঝতে পারছে। আমাদের আবহাওয়া যে পাল্টাচ্ছে তার সূচনাপর্ব আমরা নিজেরা এখন অনুভব করছি বা প্রত্যক্ষ করেছি।
এমন বৈরী আবহাওয়ায় মানুষের চরম কষ্ট হচ্ছে। ফসলের ক্ষতি হচ্ছে, চলাচলে ক্ষতি হচ্ছে। নতুন করে এসব দিকের কথা ভেবে সেই মতো ব্যবস্থা নিতে হবে। জলবায়ু সম্মেলনে বা এ ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ধনী দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানোর দাবি এবং তাদের অঙ্গীকার মতো সহায়তা পাওয়ার ব্যাপারে যেমন দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে, তেমনি আমাদের নিজেদের উদ্যোগ নিতে হবে নিজেদের চাষাবাদের ব্যাপারে। দেশের মানুষের কষ্ট লাঘব করার আরও কার্যকর ব্যবস্থা করার কথাও নতুন করে ভাবতে হবে। গ্রামীণ মানুষ বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের আরামদায়ক বসবাসের ব্যাপারে সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ নিতে হবে।
দেশের অগণিত মানুষের ঘরবাড়ি ও প্রচ- গরম বা শীতের সময় আরামদায়ক নয়। বহুজনের ঘরবাড়িও শহরের বিশেষ করে ঢাকানগরীতে বস্তি এবং ফুটপাথে বহুজনের বাস। মানুষের অতি গরম অতি বৃষ্টি বা অতি শীত সবগুলোতেই কষ্ট। বিশেষ করে এই শীতে তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় এখন অগণিত মানুষ পড়েছে অবর্ণনীয় কষ্টে। এখনই তাদের দরকার গরম কাপড়। সরকারী ও বেসরকারীভাবে এসব কিছু দেয়া হলেও সারাদেশের অভাবী মানুষের তুলনায় আরও বেশি প্রয়োজন। সরকারী এবং বেসরকারী উভয়ক্ষেত্রের উদ্যোগকে আরও ব্যাপকতর করা প্রয়োজন।
নানাভাবে মৃত্যুর কারবার এ দেশে চলে আসছে বহুকাল ধরে। ‘মন্বন্তরে মরিনি আমার মারী নিয়ে ঘর করি’Ñ গর্বের সঙ্গে এ কথা বললেও এর পেছনে এ কথাও মিথ্যা নয়, অতীতে বিভিন্ন সময় বহু মন্বন্তরে অগণিত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। প্রাণ হারিয়েছে বিভিন্ন সময় মহামারী ও মড়কে। মানুষ মরেছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ঝড়-ঝঞ্ঝা, সাইক্লোন, টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাসে। মরেছে পানিতে, বন্যায়। এমন ঘটনাই দীর্ঘকাল ধরে ঘটছে। পানির তোড়ে যেমন মরেছে মানুষ তেমনি মরেছে পানির প্লাবনে। মরেছে তীব্র শীতের মৃত্যুহিম পরশে। এটা প্রতিবছরের ঘটনা। এবাবও তাই ঘটেছে। ঘটে চলেছে। এরই মধ্যে কিছু মৃত্যুর ঘটনা শোনা গেছে এবারের শীতে। বহু এলাকায় ঘন কুয়াশা। টপ টপ করে পানির ফোঁটার মতো কুয়াশা ঝরে। কোথাও যেন মাথার কাছে মেঘ। এমনি অবস্থায় হাটে-মাঠে-বাটে, গ্রামে-গঞ্জে-নদীর পারে পারে মানুষের জীবনে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। যাদের অবস্থা ভাল, যাদের লেপতোষক, গরম কাপড়চোপড়, কোট-সোয়েটার-চাদরের অভাব নেই, তাদের কাছে এ তীব্র শীত কিছুটা হলেও সহ্য করার মতো মনে হতে পারে। কিন্তু যারা দরিদ্র, যাদের জন্য সারাদিনে উত্তাপ পাওয়ার উৎস সূর্যও ওঠে না, তাদের দিন কোনমতে কাটলেও প্রতিটি রাত যে কিভাবে কাটে তা খানিকটা অনুমান করা যায়। রাতের প্রহরগুলো তাদের কাছে হয়ে ওঠে দুঃসহতম। বয়স্ক, বৃদ্ধ, শিশু, নারীদের অবস্থা বিশেষভাবে শোচনীয়। এ অবস্থায় যাঁরা বিভিন্ন রোগে ভুগছেন তাঁদের অবস্থাও অবর্ণনীয়। দেশে এখন মোটামুটি সেই দুর্যোগই চলছে। সকলকেই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে শীতের আক্রমণে। তবে বিশেষভাবে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন দরিদ্র মানুষরা। শীত সেখানে এত তীব্র যে, শীতজনিত নানা ব্যাধি ও সমস্যার কারণে মানুষ ভুগছে। অতীতেও একই ঘটনা ঘটেছে। এবারও ঘটছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে চলবে আর কতকাল? শীতে এভাবে মানুষের দুর্ভোগ পোহানোর খবর, মানুষের মৃত্যুর খবর উন্নত দেশগুলো থেকে আমরা এত বেশি পাই না। শীত সেসব দেশে আমাদের তুলনায় অনেক বেশি পড়ে। আমাদের দেশে হিমাঙ্কের নিচে নেমে যাওয়া তো দূরের কথা, তার অতি কাছেও তাপমাত্রা নামার ঘটনা বিরল। আর ইউরোপ-আমেরিকায় তাপমাত্রা হিমাঙ্কের অনেক নিচে চলে যায়, বহু এলাকায় ওপর থেকে বৃষ্টির মতো তুষার কণা ঝরে। শীতও সেখানে বেশি পড়ে, কিন্তু এমন ভোগান্তি তাদের নেই। এর প্রধান কারণ, এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকের হামলা থেকে রেহাই পাওয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থা তারা গড়ে তুলেছে। তাদের বাড়িও যেমন গরম, তেমন গরম গাড়িও। এসবের প্রধান কারণ তারা দরিদ্র নয়; তারা দারিদ্র্য ঘুচিয়ে উন্নত জীবন যেমন গড়ে তুলেছে, তেমনি গড়ে তুলেছে সবার জন্য উন্নত সমাজ ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থায় সুফল সবাই ভোগ করে। আমাদের মতো তারা হতদরিদ্র নয়। তারা শীতেও মরে না, তাদের ভেজাল খাদ্যও নেই।
আমাদের দেশের বহু মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এখনও দারিদ্র্য আমাদের অনেকের জীবনের নিত্যসঙ্গী। বহুকালের সঙ্গী। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পেছনে যেমন ছিল রাজনৈতিক দিক থেকে স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা, তেমনি আরও ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি, দারিদ্র্য থেকে মুক্তি অর্জন করে উন্নত জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। রাজনৈতিক স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। পৃথিবীতে আর সকল স্বাধীন জাতির মতো আমরাও স্বাধীন, সার্বভৌম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার পর অনেক বছর কেটে গেলেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন আজও সফল হয়নি। এ দেশে এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে বেশকিছু মানুষ। এই অবস্থায় তীব্র শীতে দরিদ্র মানুষের সবার পক্ষে প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র কেনা সম্ভব হয় না। তাদের পড়তে হয় চরম দুর্বিপাকের মধ্যে; মহাসমস্যার মধ্যে। আমাদের গ্রীষ্মপ্রধান দেশে শীতকাল খুব বেশি দিনের নয়, তাছাড়া, তীব্র শীতও সারাটা শীতকালে বিরাজ করে না। এখানে কয়েক দিনের এই তীব্র শীতই দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জন্য ভয়াবহ হয়ে দেখা দেয়। শীতপ্রধান সকল দেশেই যেখানে আমাদের চেয়ে বহুগুণ বেশি শীত পড়ে, সেখানে জীবনযাত্রা কোনভাবেই ওই তীব্রতম শীতেও ব্যাহত হয় না। অথচ আমাদের এই অল্প শীতে মানুষকে রোগ ভোগ করতে হয়, জীবন সংশয়ও দেখা দেয়। শীত যেখানে দুনিয়াতে বড় ধরনের কোন সমস্যাই নয়, সেখানে আমাদের এই দশা কেন? এর একমাত্র কারণ আমরা দরিদ্র।
এখানে বাস্তব একটি চিত্র আমরা দেখতে পাই সেটা অত্যন্ত দুঃখজনকও। নানা ঋতুতে, নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা কঠিন পরিস্থিতিতে মৃত্যু হয় মানুষের। প্রচ- বৃষ্টি হলো। এলো বন্যা। তাতেও দেখা যায় মৃত্যুর হাতছানি। প্রচ- খরা। ঠা ঠা রোদ। সেই দারুণ দুঃসহ দিনে দেখা যায় মৃত্যুর হাতছানি। মরতে হয় দরিদ্রকে। কারণ একমাত্র দারিদ্র্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এভাবে চলবে আর কতকাল?
আমরা মনে করি, দারিদ্র্য দূর করতে না পারলে এ সমস্যার পূর্ণ ও স্থায়ী সমাধান হবে না। সেজন্য দারিদ্র্য দূর করার কাজটিকে দ্রুততর করতে হবে। আর যতদিন দারিদ্র্য থেকে যাবে ততদিন দরিদ্র মানুষরা যাতে লেপতোশক, কম্বল-চাদর, গরম কাপড়, জুতো-মোজা ইত্যাদি সহজে সুলভে সব সময় পেতে পারে, তার আরও সুন্দর ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের মানুষ যাতে সহজে ও কম মূল্যে শীতবস্ত্র কিনতে পারে সেজন্য সে ধরনের বস্ত্রের কারখানা ওই এলাকায় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। এই পৃথিবীতেই যেখানে বহু দেশের মানুষ আমাদের চাইতেও অনেকগুণ বেশি শীতে দিব্যি আরাম আয়েশে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে, সেখানে তাদের তুলনায় কম শীতে আমাদের নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ সাধারণ মানুষের একেকটি রাত কাটবে ভয়াবহ যন্ত্রণার মধ্যেÑ এ অবস্থা চলবে আর কতকাল? এই সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধানের কথা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
পৌষ শেষে এখন মাঘ। শীতের তীব্রতা আরও বাড়ার সম্ভাবনা। আমরা মনে করি, সারাদেশের বিশেষ করে দরিদ্র মানুষজনের জন্য গরম কাপড়ের কথা এখনই ভাবতে হবে। সরকারীভাবে এ ব্যাপারে কিছু ব্যবস্থার কথা শোনা যায়। এই ব্যবস্থা দ্রুত আরও ব্যাপক করতে হবে। এ ছাড়াও বেসরকারী সংস্থা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে আরও বেশি করে এগিয়ে আসতে পারে। দেশের হৃদয়বান বহু মানুষ শীতবস্ত্র দিয়ে দরিদ্রকে সাহায্য করতে চান। এ ব্যাপারে উদ্যোগ সংগঠিত করতে পারলে এই চরম সঙ্কটে সাধারণ দরিদ্র নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধের দুর্দশা ও ভোগান্তি অনেকখানি লাঘব করা সম্ভব হবে।

No comments

Powered by Blogger.