পরিবেশ সুশাসন ও কৃষি জমি by মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী

কাঁচা অর্থের লোভে এক ভয়ঙ্কর উন্মাদনা চলছে এখন বাংলাদেশে ইটভাটার নামে কৃষি জমি ধ্বংসের। দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি কৃষক ও কৃষিজমি। উর্বর কৃষি জমির অপচয় ও ধ্বংসের এমন নজির পৃথিবীর মানচিত্রে আর কোথাও আছে কি-না সন্দেহ।
প্রতিটি ইটভাটার পশ্চাতে আছে অতিসহজ পথে অর্থ উপার্জনের প্রচণ্ড অন্ধ মোহ। কৃষি জমি ধ্বংসের উর্বর স্থান যেন এ সোনার বাংলাদেশ। সম্প্রতি এক দৈনিক পত্রিকায় টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে তিন ফসলি জমি নষ্ট করে ইটভাটা নির্মাণের এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে পরিবেশ অধিদফতর দ্রুত তদন্ত করে এর সত্যতা পায়। ওই ইটভাটা মালিককে তাৎক্ষণিক পরিবেশ অধিদফতরে তলব করে ৪ লাখ টাকা শাস্তিমূলক জরিমানা আদায় করে পরদিন ভোর থেকেই তারই উদ্যোগে ও খরচে ইটভাটা ভেঙে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। পুরো ঘটনা বিশ্লেষণ করে আইন অমান্যতার এক ভয়ানক চিত্র বেরিয়ে আসে। পরিবেশ অধিদফতর, জেলা প্রশাসন এমনকি স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করেই তিন ফসলি উর্বর জমি ধ্বংস করে এ অবৈধ ইটভাটার ৫০ শতাংশ নির্মাণ কাজ রাতারাতি শেষ করা হয়। অথচ এ ইটভাটার ১০০-২০০ মিটার দূরত্বের মধ্যেই ঘিরে আছে ঘরবাড়ি এবং আবাদি জমি।
কৃষি জমি বিধ্বংসী এসব ইটভাটা গ্রামবাংলার অকৃত্রিম নিসর্গ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস এবং কৃষিকে আঘাত করছে। ফলে আগামী ৩০-৪০ বছরে কৃষি জমি শূন্যতার কবলে পড়বে বাংলাদেশ। তেমন এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি এগিয়ে আসছে আমাদের সামনে। এরপরও এ আত্মধ্বংসী তৎপরতা রোধের চৈতন্য ও বোধোদয় হচ্ছে না আমাদের! একশ্রেণীর কৃষক অথবা কৃষি জমির অকৃষিজীবী মালিক কাঁচা অর্থের প্রলোভনে মূল্যবান ফসলি জমি অবলীলায় তুলে দিচ্ছে ইটভাটার উদ্যোক্তাদের হাতে। তদন্তে দেখা গেছে, টাঙ্গাইলের এ ইটভাটা মালিক মধ্যবয়সী এক যুবক। অলস পড়ে থাকা অর্থ ও বন্ধুবান্ধব থেকে ঋণ নিয়ে স্থানীয় কয়েকজন কৃষকের ১১ বিঘা জমিতে এ ইটভাটা চালুর পরিকল্পনা তার। অথচ এ জমির পুরোটাই নয়ন জুড়ানো সবুজ ধানক্ষেত। বছরে তিনবার ফসল দেয় এ জমি। সে হিসাবে এই ১১ বিঘা জমিতে বছরে প্রায় ১৫শ' মণ ধান উৎপাদিত হতো; যার মূল্য ৮০-৮৫ হাজার টাকা। এ ধান দেশের সাড়ে ৬ হাজার মানুষের অন্নসংস্থানের উৎস। এ ইটভাটার ফলে সমপরিমাণ মানুষের অন্নসংস্থান কমে যাবে। যার বিরূপ প্রভাব শুধু কৃষি অর্থনীতিতে নয় বরং জিডিপি, খাদ্য নিরাপত্তা ও সার্বিক অর্থনীতিতেও পড়বে। জমির মালিকরা ইটভাটার জন্য প্রতি শতক জমি ভাড়া দিয়েছে বার্ষিক এক হাজার টাকায়। ধান বিক্রি করে এক শতক জমির ওপর তাদের আয় সর্বোচ্চ ৫০০-৬০০ টাকা। আর ইটভাটা থেকে পাচ্ছে তারা বিনা পারিশ্রমিকে এক হাজার টাকা। ঘাম ও রক্ত দিয়ে তিলে তিলে জমিতে ফসল উৎপাদনের চেয়ে অলস বসে সহজেই অর্থপ্রাপ্তির দিকে ঝুঁকছে নির্বোধ কৃষক। শুধু অর্থলোভে এ অপরিণামদর্শী কাজে অভিযোজিত হচ্ছে কৃষকশ্রেণী। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এভাবে গত ২০-২৫ বছরে বাংলাদেশে ৫০ লাখ একর কৃষি জমি বিলুপ্তির শিকার হয়েছে। শুধু ইটভাটা নয়, শহর, পৌরসভা ও উপজেলা সম্প্রসারণেও এভাবে কৃষি জমির ব্যবহার হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। দরিদ্র কৃষকের কৃষি জমি কিনে কোনো কোনো গ্রামে ধনীরা চোখ ধাঁধানো আবাসিক ভবন তৈরি করছে। আবাসন তৈরির এ প্রতিযোগিতায় গ্রামাঞ্চলের শত শত বিঘা কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে। এভাবে কৃষি জমি চলে যাচ্ছে অকৃষিজীবীদের অধিকারে। গ্রামের হতদরিদ্র মানুষ এক পর্যায়ে তাদের কৃষি পেশা ছেড়ে শহরে আসছে জীবিকার তাগিদে। ভূমির এ সংকট এক সময় জাতিকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে, তা সময়ই নির্ধারণ করবে। ভূমি সংকটের এ আঘাতটি সরাসরি পড়ছে কৃষির ওপর। অথচ দেশের কৃষি উৎপাদনশীলতা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে কৃষি জমির ওপর। এ ভয়ঙ্কর প্রেক্ষাপটে পরিবেশ অধিদফতর এগিয়ে এসেছে কৃষি জমি রক্ষায়। পরিবেশ অধিদফতরের পরিবেশ রক্ষার উদ্যোগের সিংহভাগই এখন কৃষি জমিকে ঘিরে। জরিমানা-উচ্ছেদ-মামলা এ ত্রিমাত্রিক আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি ইটভাটার উদ্যোক্তাদের চেতনায় প্রবিষ্ট করানো হচ্ছে এ অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের করুণ পরিণতি। শাস্তিমূলক ও নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপের সমান্তরালে চলছে পরিবেশ অধিদফতরের অনুপ্রেরণামূলক কাজ। ইটভাটা অবশ্যই হবে, তবে তা হবে উন্নত প্রযুক্তির, জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং কৃষি জমিকে সুরক্ষা করেই। আইন-কানুন, নীতিনির্দেশনা কিছুই না মেনে দুঃসাহসে ইটভাটা তৈরির এ বেপরোয়া প্রবণতার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদফতরের অভিযান মানুষকে সচেতন করছে। পরিবেশ অধিদফতর কৃষি জমি সুরক্ষার এ অভিযানে সহযোদ্ধা হিসেবে পেতে চায় জেলা প্রশাসন, স্থানীয় পৌর কর্তৃপক্ষ, জনপ্রতিনিধি এবং সর্বসাধারণকে।

মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী :পরিচালক মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট
পরিবেশ অধিদফতর, ঢাকা
mmunirc@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.